আন্তর্জাতিক

হাজার বছর ধরে জলপাই গাছের ছায়ায় ফিলিস্তিন

হাজার বছর ধরে জলপাই গাছের ছায়ায় ফিলিস্তিন

তাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিদের আয়ের একটি স্থির ও শক্তিশালী উৎস জলপাই গাছ। যার ছায়ায় হাজার বছর ধরেই বেঁচে আছে ফিলিস্তিন। গাজার মাটিতে এখনো অনেক গাছ আছে যেগুলো ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জাতি হয়ে গড়ে ওঠারও কয়েকশ বছর আগে রোপণ করা হয়েছে। সেগুলো যুগে যুগেই ফিলিস্তিনিদের পুরাতন মর্যাদা নিয়ে মাথার ওপর ঢাল হয়ে আছে। পূর্বপুরুষ আর হারানো ঐতিহ্যের মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে পুরো ফিলিস্তিনকে।

 

নাকবার (বিপর্যয়, ১৯৪৮) সময় বহু গাছ কেটে ফেলা হলেও সূর্যের ছায়ায় শক্ত শিকড় গেড়ে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু গাছ। ৭৫ বছর ধরে ইসরাইলের দখলদারিত্বের মুখ্য সাক্ষী, বোবা বন্ধু আর শান্তির আশ্রয় এ জলপাই গাছগুলোই। সেই জলপাই গাছই এখন পুড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইলের দখলদার বসতি স্থাপনকারীরা।

 

ফিলিস্তিনে প্রাকৃতিক দৃশ্য, শান্তি, আশা এবং ভরণপোষণের স্থায়ী প্রতীক হিসাবে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জীবিকার প্রধান উৎস হিসাবে জলপাই চাষ এবং জলপাই তেল উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে আসছে। ফিলিস্তিনি অঞ্চলের প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ পরিবার আয়ের প্রাথমিক অথবা গৌণ উৎস জলপাই এবং জলপাই তেল।

 

স্থানীয় অর্থনীতির প্রায় ১৪ শতাংশই জলপাই ব্যবসা। তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য জলপাই গাছ শুধুই কৃষি নয়-এটি তাদের মর্যাদা ও জাতীয়তার সঙ্গেও সরাসরি জড়িত। কেউ কেউ এটিকে ফিলিস্তিনি পরিচয়পত্র, ইতিহাস, এমনকি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। গাজায় সাধারণত প্রতিবছর ৫ হাজার টন অলিভ অয়েল উৎপাদিত হয়। এটি এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙা করতে এবং অসংখ্য পরিবারকে সমর্থন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

টানা ১৬ বছরের ইসরাইলি অবরোধ সহ্য করেও গাজার কৃষকরা ধারাবাহিকভাবে মানসম্পন্ন জলপাই তেল তৈরি করেছে। তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে এবারের চলমান যুদ্ধে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন কৃষকরা। ইসরাইলি বাহিনী প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের চোখের সামনে তাদের গাছগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ বোমার আঘাতে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন শেষ করে দিচ্ছে।

 

পশ্চিম তীরে পর্যবেক্ষকরা রিপোর্ট করেছেন, এই বছরের ১২ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি গ্রামে আক্রমণ করছে। কৃষকরা প্রতিনিয়ত হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। রাসায়নিক দিয়ে ফসল স্প্রে করে ফল নষ্ট করে দিচ্ছে। এমনকি শত শত জলপাই গাছ উপড়েও ফেলছে। ১৯৪৮ সালের নাকবার (বিপর্যয়) পর থেকে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ৮ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি জলপাই গাছ অবৈধভাবে কেটে ফেলেছে।

 

অনেক পরিবার আবার উপায় না পেয়ে প্রয়োজনের তাগিদে নিজেরাই গাছ কেটে ফেলছেন। গাজার বাসিন্দা আহলাম সাকারের (৫০) ছেলেরা কাঁদতে কাঁদতে তার জলপাই গাছের ডাল কাটতে শুরু করে। যাতে রান্নার জন্য আগুন জ্বালাতে পারে। ইসরাইলি বর্বর বোমাবর্ষণ এবং অবরোধ বেশিরভাগ বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করেছে। একই সাঙ্গে জ্বালানি, চুলার জন্য গ্যাস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এজন্য চরম দুর্দশা ও সংকটে নিজেই নিজেদের ভালোবাসার প্রতীক কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন।

 

রোলা (৫৫) দক্ষিণ লেবাননের সেদ্দেকিন গ্রামে একটি ছোট জমির মালিক। সেখানে তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জলপাই কাটার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফল সংগ্রহ করেন। জলপাইয়ের তেল বের করে সেগুলো বিক্রি করেন। তবে গ্রামটিতে এই বছরে প্রত্যাশিত ফসল পাওয়া যায়নি।

 

৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তেও হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। যার জের ধরে এ অঞ্চলের কৃষিতে শ্বেত ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ করে অনেক জলপাই গাছ পুড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। ফলে দক্ষিণ লেবাননে প্রায় ৪০ হাজার জলপাই গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজাতেও একই অস্ত্র ব্যবহার করছে সেনারা।

 

শুধু গাজা বা পশ্চিম তীর নয়, প্রাচীনকাল থেকে জলপাই গাছ সিরিয়া ও লেবাননজুড়েও অপরিসীম আঞ্চলিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব ধরে রেখেছে। এর চাষাবাদ এই অঞ্চলগুলোর প্রাচীন সভ্যতার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও জলপাই গাছ একাধিকবার উদ্ধৃত করা হয়েছে। জলপাই গাছকে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া গ্রিক পুরাণেও জলপাইকে শান্তির প্রতীক বলা হয়েছে। একটি জলপাই গাছের গড় আয়ু প্রায় ৫০০ বছর।

 

আরও খবর

Sponsered content