আন্তর্জাতিক

কী ভুল ছিল মোদির, কেন পেলেন না একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা?

টানা তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদির দল এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বটে, তবে যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততটা সহজে বিজেপি জিততে পারেনি। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২৪০টি আসন পেলেও দিল্লি দূর অস্ত। কারণ, দিল্লির মসনদে পৌঁছাতে দরকার ২৭২টি আসন।

 

মোদি এখন কী করবেন? তাঁর শরিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও টানা দুই মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির জন্য এটি এক ধরনের ‘চপেটাঘাত’। তিনি এর আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন।

এবারও নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর দল ৪০০টির বেশি আসনে জিতে এককভাবে সরকার গঠন করবে। গত এক দশক ধরে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছেন, এবং যেভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার চালিয়েছেন, তাতে ধারণা করা গিয়েছিল, তাঁর দল বিজেপি এই লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে।

কিন্তু ফল ঘোষণার পর দেখা গেল, নরেন্দ্র মোদি প্রবল চপেটাঘাত খেয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার, সরকার গঠন করতে এখনো ৩২টি আসন দূরে আছেন তিনি। এই ৩২টি আসন জোগাড় করতে তাঁকে ‘পরনির্ভরশীল’ হতেই হচ্ছে।

এবারের লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, কংগ্রেসের পুনরুত্থান। ২০১৪ ও ২০১৯–এর নির্বাচনে যেভাবে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল, তাতে সবাই ধরেই নিয়েছিল, কংগ্রেস আর কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এবারের নির্বাচনের পর বুথফেরত জরিপগুলোতেও দেখা যাচ্ছিল, বিজেপির জয়জয়কার—কংগ্রেস ‘নেই বললেই চলে’।

কিন্তু নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল সব ভবিষ্যদ্বাণী উল্টে দিয়েছে। কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯টি আসন। আর জোটগতভাবে পেয়েছে ২৩৪টি আসন।

গত দেড় মাস ধরে ভারতে সাত দফায় লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছে। ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছিল ১৯ মে; শেষ হয়েছে ১ জুন। আর চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হলো ৪ জুন। এবারের নির্বাচনে ৬৪ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন। ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, এটি একটি ‘বিশ্ব রেকর্ড’। এই বিপুলসংখ্যক ভোটারের অর্ধেকই নারী।

বিজেপি এখনো আসনের দিক থেকে ভারতের একক বৃহত্তম দল। শরিকদের সঙ্গে নিয়ে মোদি যদি তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি হবেন জওহরলাল নেহরুর পর প্রথম ব্যক্তি যিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।

কিন্তু বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় মোদির তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়ার সম্ভাবনা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। ফলে বিজেপি শিবিরে কিছুটা হতাশা, আর বিপরীতে কংগ্রেস শিবিরে উল্লাস দেখা যাচ্ছে।

মোদির সমর্থকেরা মনে করেন, মোদি তাঁর শাসনামলে শাসন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা, দক্ষ কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, ধারাবাহিকভাবে দেশের উন্নয়ন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নসহ বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। এ জন্য তৃতীয় মেয়াদেও মোদিরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত।

তারপরও টাল খেল ‘মোদি ব্র্যান্ড’
নরেন্দ্র মোদি তাঁর দুই দশকের শাসনামলে সবচেয়ে বড় দুটি সুবিধা পেয়েছেন। এক. শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা; আর দুই. ভারতের প্রায় সকল গণমাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা।

এই দুই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ‘মোদি ব্র্যান্ড’ দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। বিশেষ এই প্রচারের মাধ্যমে নিয়মিত কাজকেও তুলে ধরা হতো ফলাও করে।

কিন্তু গতকালের নির্বাচনী ফলাফল বলছে, মোদি ব্র্যান্ড তাঁর উজ্জ্বলতা কিছুটা হলেও হারিয়েছে। মোদিকে যতটা অপ্রতিরোধ্য ভাবা হয়েছিল, তিনি ততটা নন। তাঁকেও বধ করা যায়। এই বিষয়টি বিরোধীদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

জোট রাজনীতির প্রত্যাবর্তন
ভারতে ৮০, ৯০ ও চলতি শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত কোনো দলই লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। জোটের মাধ্যমেই সরকার গঠন করতে হয়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এসে সেই ধারা ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি গত দুই মেয়াদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন।

কিন্তু এবার সেই ধারায় ছেদ পড়ল। আবার ফিরে এল জোটের রাজনীতি। মোদির দল বিজেপি এবার ম্যাজিক ফিগার ২৭২ আসনে জয় নিশ্চিত করতে পারেনি।

ফলে বিজেপিকে সরকার গঠন করতে হলে জোটের ওপর নির্ভর করতে হবে। পরামর্শ নিতে হবে শরিক দলগুলোর। কোনো কারণে শরিক দলের নেতারা অবেহেলিত বোধ করলে ভেঙে যেতে পারে জোট।

বড় ‘ধাক্কা’ খেল বিজেপি
গত এক দশকের শাসন ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর পেছনে মোটা দাগে পাঁচটি কারণ রয়েছে। এক. একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা; দুই. কতিপয় ব্যবসায়ীর হাতে সম্পদের কুক্ষিগতকরণ; তিন. অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা; চার. সংকুচিত স্বাধীনতা এবং পাঁচ. বিরোধীদের দমন।

তবে মোদিই শুধু একটানা দেশ শাসন করছেন—এমন নয়। স্বাধীন হওয়ার পর বহু বছর কংগ্রেস বিরতিহীনভাবে ভারত শাসন করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গতকাল মঙ্গলবারের নির্বাচনী ফলাফল ভারতে আবার ‘স্বাভাবিক রাজনীতি’ ফিরিয়ে এনেছে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।

বিরোধীদের পুনরুত্থান
বিজেপিকে মোকাবিলা করার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে বিরোধীরা ‘ইন্ডিয়া’ নামে জোট গঠন করে। কিন্তু এর অল্প সময় পরই ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম নেতা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার জোট ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন।

এরপর পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও আর জোটে অতটা সক্রিয় ছিলেন না। ফলে ধারণা করা হয়েছিল, ইন্ডিয়া জোট হয়তো টিকবে না।

কিন্তু কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী হাল ছাড়েননি। তিনি সারা ভারত পায়ে হেঁটে বিরোধীদের সংগঠিত করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন এবং নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন।

এর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেছে লোকসভা নির্বাচনে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট ভারতজুড়ে ২৩৪টি আসনে জিতেছে। এটিকে বিরোধীদের ‘পুনরুত্থান’ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

যে কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেন মোদি
নরেন্দ্র মোদির এক দশকের শাসনামলে ভারতের অর্থনীতি নাজুক হয়েছে। আয়‑বৈষম্য বেড়েছে। অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের বেঁচে থাকতে নাভিশ্বাস উঠেছে, আর বেকারত্ব বেড়েছে চরমভাবে।

বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ২৫ বছরের কম, তারা ভয়ানক হাতাশার মধ্যে রয়েছে। এই তরুণেরা এবারের নির্বাচনে মোদির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভিন্নমত দমন ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রান্তিকরণের ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে মোদির বিরুদ্ধে। তাঁর শাসনামলে মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে বিরোধী অনেক নেতাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল মোদি প্রশাসন।

এ ছাড়া ‘আব কি বার, ৪০০ পার’ স্লোগানও হীতে বিপরীত হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, মোদির এমন প্রচার ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন শঙ্কা হয়তো বাড়িয়ে দিয়েছিল যে, মোদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাঁদের নিয়ে সংবিধানে নেতিবাচক পরিবর্তন আনা হতে পারে। তাই তাঁরা বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।

এই সবকিছু মিলিয়ে মোদির দল বিজেপি জনগণের আস্থা হারিয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ব্যালট বাক্সে। তাই এবারের নির্বাচনে মোদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে ও এনডিটিভি

 

আরও খবর

Sponsered content