সারাদেশ

সিলেটের ওসমানী মেডিকেলে দালাল ও চোর চক্রের দৌরাত্ম্য

সিলেটের ওসমানী মেডিকেলে দালাল ও চোর চক্রের দৌরাত্ম্য

চল্লিশোর্ধ রহিমা বেগমের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। গত ১৯ জুলাই বেলা ১১টার দিকে কাঁদছিলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে। কারণ জানতে চাইলে বলেন, অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি কিশোর ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। ওষুধের স্লিপ হাতে দেখে এক যুবক এগিয়ে এসে খাতির জমায়। পরে একটি ফার্মেসিতে নিয়ে তাঁকে সামনে দাঁড় করিয়ে ওষুধের স্লিপ নিয়ে ভেতরে যায়। দুই মিনিট পর ফিরে এসে দাম জানায় ১ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর টাকা নিয়ে ফার্মেসির ভেতর ঢুকে লাপাত্তা হয়ে যায়। এক ঘণ্টা দাঁড়ি থেকেও ওই যুবককে না পেয়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি।

গত ১০ আগস্ট গলার টিউমারের অস্ত্রোপচারের জন্য নাক কান গলা বিভাগে ছেলেকে ভর্তি করান বশির উদ্দিন। জরুরি বিভাগের সামনে সাইফুল নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে ওষুধ কিনতে মামণি ফার্মেসি নামে একটি দোকানে নিয়ে যায় তাঁকে। সেখানে ওষুধের দাম চাওয়া হয় ৩ হাজার ২৬০ টাকা। দাম নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় পরে আরেক ফার্মেসি থেকে সেই ওষুধই বশির কেনেন ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। এ ছাড়া ৭ আগস্ট হাসপাতালের লিফট থেকে এক গণমাধ্যমকর্মীর মানিব্যাগ চুরি হয়। পরে ১৪ আগস্ট একটি ওয়ার্ড থেকে আটক করা হয় এক মোবাইল ফোন চোরকে।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই দালাল ও চোরচক্রের কবলে পড়ছেন সিলেটের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজন। তাদের খপ্পরে পড়ে খোয়াচ্ছেন টাকা, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিস। মাঝেমধ্যে ওয়ার্ড থেকেও রোগীর ওষুধ চুরির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ওয়ার্ডে চুরির সঙ্গে নার্স, আয়া ও আউটসোর্সিংয়ের লোকজন জড়িত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, দালাল ও চোরদের কাছ থেকে মাসিক টাকার ভাগ পান অনেকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, হাসপাতালে দায়িত্বরত জেলা পুলিশের সদস্য, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ শাখার দায়িত্বশীল ও হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। দালালরা প্রতিদিন পুলিশকে ৩০০ ও আনসার কমান্ডারকে ২০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে ঢোকে। চিহ্নিত চোররাও ভাগ দেয়। বর্তমানে হসপাতালকে কেন্দ্র করে এমন অর্ধশত দালাল ও চোর সক্রিয়। পুলিশ, আনসার ও ওয়ার্ডের দায়িত্বশীলরা চিনলেও বাড়তি সুবিধার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মাঝেমধ্যে দু-একজনকে আটক করা হলেও চিহ্নিতরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ওসমানী হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জুয়েল চৌধুরী অবশ্য বলেন, প্রায়ই পুলিশ দালাল ও চোরদের আটক করছে। কাউকে তারা চেনেন না।
দালাল ও চোরচক্রের কারণে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানটির বদনাম হচ্ছে উল্লেখ করে ওসমানী হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির দাতা সদস্য আবদুল জব্বার জলিল বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়লে এটি থামানো সম্ভব। আগামী সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করব।

ওসমানী হাসপাতাল সিলেট বিভাগে সরকারি চিকিৎসার প্রধান ভরসাস্থল। সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ছাড়াও প্রতিদিন অনেক জায়গা থেকে রোগী ভর্তি হন এখানে। ৯০০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যায় থাকে আড়াই হাজারের ওপরে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন সমসংখ্যক রোগী।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, এক রোগীর সঙ্গে তিন থেকে পাঁচজন পর্যন্ত স্বজন দেখা যায়। এতে কে দালাল বা চোর, তা চিহ্নিত করা মুশকিল। আমরা মারধর করে কাউকে বের করে দিতে পারি না।

অভিযোগ রয়েছে, দালালদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক ফার্মেসি। এর মধ্যে ২ নম্বর গেটের সামনের মালিপাড়া গলিতে রয়েছে এমন আটটি ফার্মেসি। এসব ফার্মেসিকে কেন্দ্র করে আঙ্গুর, মাহমুদ, মানিক, কয়েস, সায়েম, কালাম, জাহেদ, শাহিন, কামরুল, মাসুম, সুহেল, হুসেন, মিলন, সাইফুল, আল আমিনসহ ২০-২৫ জনের একটি দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের মধ্যে সাইফুলের সঙ্গে কথা হলে জানান, তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জে। কোনো রোগীর স্বজন সহযোগিতা চাইলে করেন। কাউকে ঠকান না। চোরদেরও রয়েছে সিন্ডিকেট। বিভিন্ন ওয়ার্ডে সন্ধ্যা ও রাতে এদের বেশি দেখা যায়।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, ১, ৩, ৬, ১১, ১৫, ২৬ নম্বরসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে বেশি চুরি হয়। এমনকি হাসপাতালের স্টাফদের মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল চুরির ঘটনাও ঘটেছে। ওয়ার্ড থেকে রোগীর স্বজন স্লিপ নিয়ে বের হলেই কম দামে বা বাকিতে ওষুধ কিনে দেওয়ার কথা বলে ভাগিয়ে নিয়ে যায় দালালরা। ৭০০ টাকার ওষুধ সাত হাজার টাকা রাখার নজিরও রয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content