সারাদেশ

বহু অপকর্মের বোঝা নিয়ে বিদায় সভাপতি-সম্পাদক

চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটির ‘নাটাই’ হাতে পেয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক। দু’জনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের আখের গোছাতে। গত সাড়ে পাঁচ বছর ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম চালিয়েছেন তারা।

 

কলেজে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়েন দুই নেতা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ টাকার একটি খাম ১০০ টাকায় বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। এভাবে অ্যাডমিট, রেজিস্ট্রশন কার্ডসহ নানা খাতে বাড়তি টাকা আদায় করেন তারা।

 

ক্যাম্পাস ও আশপাশের বিভিন্ন দোকান থেকে মাসওয়ারি চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের হাতে কলেজের বিভিন্ন পদে দায়িত্বরত ২০ জনের বেশি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী লাঞ্ছনার শিকারও হয়েছেন। এক কর্মচারীকে মারধরের ঘটনা মন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তারা দু’জনই শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

 

দীর্ঘদিন একই পদে রয়েছেন তারা। নেতাকর্মীরা জানান, এক বছরের কমিটি চলেছে সাড়ে পাঁচ বছর। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাহমুদুল এবং সুভাষের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়।

 

এর আগেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-অপরাধের নানা অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে তাদের অপরাধের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ১৭ মে কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। এরই মধ্যে দুই নেতাকে কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সমকালকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ নিয়ে আমরাও বিব্রত। সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পেয়েছি। এজন্য কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের তদারকি করতে বলেছি।

 

কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক নেতা বলেন, ‘দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ভারী হওয়ায় ও নানা মহলের চাপে পড়ে কমিটি বিলুপ্ত করতে এবার বাধ্য হয়েছেন শীর্ষ নেতারা।

 

চকবাজার থানার ওসি ওয়ালি উদ্দিন বলেন, ‘ছোটখাটো বিষয় নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ। বেশির ভাগ সময় তাই আমাদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। ক্যাম্পাসে বাড়তি পুলিশ রাখতে হয়।

 

 

জানা গেছে, চট্টগ্রাম কলেজে প্রতিবছর ভর্তি কার্যক্রমের খাম ও ফাইল বিক্রির দায়িত্বটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক সিন্ডিকেট করে কৌশলে নিয়ে নেয়। কলেজে এবার ৩ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি-সংক্রান্ত কাজের জন্য খাম কিনতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। সাইজভেদে একটি খামের দাম ৫ থেকে ২০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা আদায় করেছে ১০০ টাকা।

 

এভাবে খাম বিক্রি বাবদ ৩ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন সভাপতি-সম্পাদক। বিগত বছরগুলোতেও এভাবে টাকা আদায় করেছেন তারা। বাড়তি টাকা দিয়ে খাম কিনতে রাজি না হওয়া বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে ভয়-হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে দুই নেতার বিরুদ্ধে।

 

খামের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা নেওয়ায় ৯ মে সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক ও তাঁর লোকজনকে বাধা দেন সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। তাতে আহত হন বেশ কয়েকজন।

 

কলেজের চারপাশে থাকা শতাধিক স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাসমান দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা দাবির অভিযোগও পাওয়া গেছে দুই নেতার বিরুদ্ধে। ভ্যানে ফেরি করে নানা সামগ্রী বিক্রি করা দোকানিদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়।

 

এ ছাড়া রিকশা, টেম্পোসহ বিভিন্ন গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করেন তারা। কেউ চাঁদার টাকা দিতে না চাইলে নির্যাতন শুরু হয়। এক দোকানি বলেন, টাকা দিতে গড়িমসি করলেই চড়থাপ্পড় মারে।

 

সাধারণ সম্পাদকের মতামত না নিয়ে কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কমিটি গঠন করায় ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালানো হয় কলেজের প্রধান অফিস সহকারী গোলাম কিবরিয়ার ওপর।

 

সুভাষ মল্লিকের নেতৃত্বে একটি দল গত বছরের ২২ ডিসেম্বর তাঁর ওপর এই হামলা চালায়। সেই সময় কমিটি বন্ধ করতে অধ্যক্ষ বরাবর আবেদনও দেন সুভাষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ হয়ে যায় কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের কমিটি গঠন।

 

চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম বলেন, সভাপতি ও সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ পেয়েই বেপরোয়া হয়ে যান মাহমুদুল করিম ও সুভাষ মল্লিক। কলেজের উন্নয়নমূলক নানা খাত থেকে চাঁদা আদায় করেন তারা। কলেজের শিক্ষক বদলিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তারা।

 

আরেক সহসভাপতি জেড মনির বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি ও নারী কেলেঙ্কারির অহরহ অভিযোগ রয়েছে মাহমুদ-সবুজের বিরুদ্ধে।

 

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু বলেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলাসহ নানা অভিযোগ পাওয়ায় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। অভিযোগের যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

 

অভিযোগ প্রসঙ্গে সভাপতি মাহমুদুল করিম বলেন, ‘যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সবই ভিত্তিহীন। এসব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।’ সুভাষ মল্লিক বলেন, ‘ছাত্রলীগের একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পেছনে লেগেছিল। উত্থাপিত অভিযোগগুলো তাদের অনেক দিনের পরিকল্পনার ফসল।

 

আরও খবর

Sponsered content