সারাদেশ

মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন পাঁচ শিক্ষার্থীকে স্কুল মাঠে ফেলে: ঝালকাঠি

মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন পাঁচ শিক্ষার্থীকে স্কুল মাঠে ফেলে: ঝালকাঠি

ঝালকাঠির রাজাপুরের ৯ নম্বর লেবুবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন সোহাগের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির ৫ শিশু শিক্ষার্থীকে স্কুল মাঠে ফেলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্লাসরুমে খেলা করা ও স্কুলে পড়া না পারার অভিযোগ তুলে ওই স্কুলশিক্ষক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা।

 

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) এ ঘটনায় সাতুরিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সমীরেন্দু বিশ্বাসকে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম নুরুল আলম মৃধা।

 

গত রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর লেবুবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।

 

ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন সোহাগের এ অমানসিক কাণ্ডে অভিভাবকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হয়ে জ্বরে আক্রান্ত এবং অপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করায় ক্লাসে উপস্থিতি কমে গেছে।

 

আহত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন সোহাগ ব্ল্যাকবোর্ডে দুটি প্রশ্ন লিখে তা পড়তে বলে অন্য রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে এসে শিশু শিক্ষার্থীদের পড়া না হওয়ায় এবং ক্লাসে বসে দুষ্টুমি করার অপবাদ দিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুরসালিন, আবু সালেহ, সিয়াম, নাজমুল ও শাকিবকে প্রথমে ক্লাস রুমে বসে চড়থাপ্পড় মারাসহ নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করে।

 

তাতেও খ্যান্ত হননি শিক্ষক সোহাগ। পরে তাদের টেনেহিঁচড়ে মাঠে নামিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও বেত দিয়ে বেধড়ক মারধর করতে করতে মাঠে ফেলে ৫ শিক্ষার্থীকে অমানসিক প্রহার করা হয়। মাঠে ফেলে বেধড়ক মারধর করলেও কয়েক শিক্ষার্থী অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় অপর দুই ছাত্রী আয়শা ও সামিয়াকেও মারধরের ভয় দেখালে এক শিক্ষার্থী অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

 

ঘটনা দেখে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে অপর দুই শিক্ষক এসে অভিযুক্ত শিক্ষকের হাত থেকে বেত টেনে নিয়ে যায় এবং শান্ত করে। এ ঘটনার পর পঞ্চম শ্রেণির ৩৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪ শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যরা ভয়ে স্কুলে আসেনি বলেও অভিযোগ অভিভাবকদের। অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার ও আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি করা হয়।

 

আহত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মুরসালিনের মা লালয়া বেগম বলেন, তার শিশু ছেলেকে কখনো তারা নিজেরাও গায়ে হাত দেন না কিন্তু ওই শিক্ষক সোহাগ শিশু শিক্ষার্থীর কানে সজোরে চর মারাসহ বেত দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে।

 

তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ওষুধ খাওয়ালেও রাতে সে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়। ওই শিক্ষক স্কুলে থাকলে এ স্কুলে আর তার ছেলেকে পড়াবেন না বলেও জানান তিনি। সকালে প্রাইভেট পড়তে পারেনি এবং স্কুলেও আসতে পারেনি। অভিযুক্ত শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করাসহ কঠোর বিচার দাবি করেন ওই অভিভাবক।

 

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আহত আবু সালেহের মা মাকসুদা বেগম বলেন, তারা না পড়িয়ে পড়তে দিয়ে অন্যত্র চলে যান শিক্ষক সোহাগ। কিছু না পড়িয়ে এভাবে পড়া দেওয়ায় শিশুরা খুঁজে পড়া বের করে পড়তে ও শিখতে না পারায় তার ছেলেকে মারধর করা হয়েছে।

 

তাকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে, তারপরও সারারাত বাচ্চা ঘুমের মধ্যে চিল্লায়ে উঠেছে, সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ভয় পেয়েছে, তাই এ স্কুলে আর আসতে চায় না। শিক্ষক সোহাগকে স্কুল থেকে না সরালে এ স্কুলে আর তার শিশুকে পড়াবেন না বলেও জানান তিনি।

 

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাইফ মাহমুদের মা খাদিজা বেগম বলেন, ছাত্র ছেলে ভয়ে বাড়িতে বসেও কান্নাকাটি করেছে। এমনভাবে শিশুদের মারধর করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না। শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের ভয়ে স্কুলে আসতে চাচ্ছে না এবং তাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করা হয়।

 

অভিযুক্ত লেবুবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন সোহাগ বলেন, ক্লাসে না পড়ে কলম খেলায় এবং বেয়াদবি করায় কয়েক শিক্ষার্থীকে চড়থাপ্পড় ও কয়েকটি বেত্রাঘাত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা না করা ও ক্লাসে দুষ্টুমি করায় শাসন করা হয়েছে।

 

লেবুবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়টি শিক্ষা অফিসার ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে জানানো হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে।

 

তিনি আরও বলেন, ওইদিন দুজন শিক্ষক মিলে তাকে নিবৃত করেছে তারপরও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করা হয়েছে এবং কয়েক শিক্ষার্থী অচেতন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এর আগেও অভিযুক্ত এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মারধর ও উগ্র আচরণের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী।

 

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া ও সাতুরিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সমীরেন্দু বিশ্বাসের কাছে জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে জানান, মঙ্গলবার ওই স্কুলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

 

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম নুরুল আলম মৃধা বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। সাতুরিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে সরেজমিনে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হযেছে। প্রতিবেদন পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিতপূর্বক অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

বিষয়টি রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইয়াসমিনকে সাংবাদিকরা অবহিত করলে তিনি জানান, বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর

Sponsered content