জাতীয়

লোডশেডিংয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা

লোডশেডিংয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা

১০ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট, ১৪ ঘণ্টা ২৫ মিনিট, ১৮ ঘণ্টা ১০ মিনিট– এগুলো কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সূচি নয়; ২০ আগস্ট থেকে যথাক্রমে তিন দিন ময়মনসিংহের নান্দাইলের চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের বাঁশহাটী বাজারের ‘টার্গেট ফাইন নিট’ কারখানায় লোডশেডিংয়ের তালিকা। চণ্ডীপাশার মতো অন্যান্য অঞ্চলেও একই দশা। এর ফলে গত কয়েক বছরে মফস্বলে বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার যে প্রসার ঘটেছে, তা ফিকে হতে বসেছে। থমকে দাঁড়িয়েছে হ্যাচারি ও পোলট্রি খাত। বন্ধের পথে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোগ। লোকসান গুনে ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ খাতের অগ্রযাত্রায় পড়েছে ছেদ; বাড়ছে বেকারত্ব। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির পালে যে দুর্বার হাওয়া লেগেছিল, তা টেকসই হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

টার্গেট ফাইন নিট কারখানার প্রোডাকশন ডিরেক্টর মো. কামরুজ্জামান জানান, বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। ডিজেলে কারখানা চালাতে গিয়ে মাসে বাড়তি ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি, বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা কম থাকায় রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে তেমন লোডশেডিং হচ্ছে না। তবে এর মধ্যেও মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে দিনে গড়ে ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সুষম উন্নয়নের স্বার্থে শহরের মতো মফস্বলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, ‘সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা জোরেশোরে বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। গ্রামের মানুষ ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায় না। একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে সরকার একের পর এক অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে। এসব কেন্দ্রের অধিকাংশ উৎপাদন না করেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরছে। এ লোকসান কমাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে দাম। কিন্তু মানুষ বাড়তি অর্থ খরচ করেও বিদ্যুতের দেখা পাচ্ছে না।’

বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চাহিদা অনুসারে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও লোডশেডিং নেই। গ্রামে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে এটি লোডশেডিং নয়, বিতরণ লাইনজনিত বিভ্রাটের কারণে এমন হচ্ছে।’

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দিনে তাদের এলাকায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বেশি ভোগান্তি পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকদের। বগুড়াতেও একই অবস্থা। জানতে চাইলে বগুড়ার শিবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আবদুর রহিম জানান, চাহিদার তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন তারা। পর্যায়ক্রমে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।

ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিশে বলা হয়েছে, উৎপাদন-স্বল্পতায় এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। তবে এ জেলার ফুলগাজীতে দিনে কমপক্ষে ১৪ ঘণ্টা ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে দিনের বেলা লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। জেলার বোয়ালখালীতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। আর আনোয়ারায় গত বুধবার অন্তত ১৫ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে।

বিপাকে হ্যাচারি ও পোলট্রি খাত

লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে মুরগি মারা যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন। সিলেট ওসমানীনগরের মাটিহানী গ্রামের খামারি সুজিত কুমার দেব জানান, লোডশেডিংয়ে গত তিন মাসে তাঁর প্রায় দেড় লাখ টাকার মুরগি মারা গেছে। বরগুনার পাথরঘাটার খামারি খলিল পহলান জানান, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জেনারেটর ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

বিদ্যুৎ সংকটে চলতে পারছে না হ্যাচারিগুলো। ধুঁকছে কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যমুনা হ্যাচারির ব্যবস্থাপক ফিরোজ হোসেন জানান, ডিজেল ব্যবহারের কারণে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২৫ ভাগ বেড়ে গেছে।

বিঘ্নিত সেচ কার্যক্রম

ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় চাহিদামতো সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। পানির অভাবে আমনক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।  কৃষকরা বলেছেন, বৃষ্টি না হলে বা সেচের মাধ্যমে সময়মতো ক্ষেতে পানি না দিলে চারা মরে যাবে; ব্যাহত হবে ফসল উৎপাদন। রংপুরের মিঠাপুকুরের হামিদুল ইসলাম জানান, অগভীর নলকূপের সাহায্যে তিনি ৫০ বিঘা জমিতে সেচ দেন। লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো সেচ দিতে না পারায় কৃষকরা গালমন্দ করেন।
রাজশাহীর চারঘাটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আমনের চারা রোপণের পর পানির অভাবে ক্ষেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে বরেন্দ্রর গভীর নলকূপের পানি সময়মতো জমিতে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যয় বেড়ে বন্ধের পথে কুটির ও মাঝারি শিল্প

লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা চরম বিপদে পড়েছেন। উৎপাদন কমে গেছে। অনেকে কর্মচারী ছাঁটাই করেছেন। ফলে রুদ্ধ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ। বগুড়ার শিবপুরের সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের শীতের কাপড় ও মোজা তৈরির কারিগর তোতা মিয়া (৬৫) জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকঠাক শীতের কাপড় তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে কারখানা না চললেও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সাদিপুরের ফখর অটোরাইস মিলের মালিক মো. জাহাঙ্গীর।

রংপুরের মিঠাপুকুরের নর্থ বেঙ্গল জুট মিলে দিনে গড়ে তিন হাজার পিস চটের বস্তা তৈরি হতো। লোডশেডিংয়ের ধাক্কায় উৎপাদন হচ্ছে দিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ পিস। জুট মিলের পরিচালক নাজমুল হক বলেন, ‘এখানে ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় গত ছয় মাসে শতাধিক কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে।’

বিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে গ্রামগঞ্জে অনেকে ফটোকপি, কম্পিউটার-ইন্টারনেট সেবার মতো ছোট ছোট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। লোডশেডিংয়ের কারণে এ ধরনের ব্যবসায়ীদের এখন পথে বসার উপক্রম। বগুড়ার মোকামতলা ইউনিয়নের গণেশপুর এলাকার রাবিজা কম্পিউটার্সের কর্ণধার মেহেদী হাসান জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকমতো ফটোকপি, কম্পোজ ও প্রিন্টের কাজ করা যাচ্ছে না।

ব্যাহত চিকিৎসাসেবা

লোডশেডিং গ্রামগঞ্জের অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, চিকিৎসক এক্স-রে দেন। বিদ্যুৎ না থাকায় ১০ মিনিটের এক্স-রে করতে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা মো. মনিরুজ্জামান জানান, বিদ্যুৎ থাকছে না; জেনারেটরও নষ্ট। এ জন্য সময়মতো পরীক্ষা করানো সম্ভব হচ্ছে না। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে বলে জানান রোগী লাভলু সরদার।

বিপদে জেলেরা

লোডশেডিংয়ের কারণে বরফকলগুলো ঠিকমতো চলছে না। সাগর ও হাওর এলাকার জেলেরা বিপদে পড়েছেন। মাছ সংরক্ষণে সমস্যা হচ্ছে। বরফের দামও বেড়ে গেছে। বরগুনার পাথরঘাটায় দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। ইলিশের ভরা মৌসুমে ২৪ ঘণ্টা এখানকার ২১টি বরফকল উৎপাদন করেও চাহিদা পূরণ করতে পারে না। অথচ বিদ্যুৎ সংকটে এখন আট ঘণ্টাও চলছে না বরফকল।

কেবি বরফকলের মিস্ত্রি সোহাগ মিয়া বলেন, বর্তমানে সাগরগামী ট্রলারে বরফের চাহিদা বেশি। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে বরফ হচ্ছে না। চাহিদার অর্ধেক বরফ দিয়েই জেলেদের বিদায় করতে হচ্ছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা ব্যুরো ও রংপুর অফিস]

আরও খবর

Sponsered content