ধর্ম

ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান কত হওয়া উচিত

স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান নিয়ে নানাজন নানা মতামত দিয়েছেন। বিয়ে মানুষের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সঠিক পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে জীবনে নেমে আসে আনন্দের ধারা। আর পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ভুল করলে জীবন নরকে পরিণত হয়। বিয়ে কোনো আবেগের বিষয়। বরং বাস্তবতা ভেবে বিয়ে করা উচিত। বিয়ের মাধ্যমে দুজন অচেনা, অজানা মানুষ ভালোবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ হন।

 

বিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইদানীং স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য নিয়ে বেশ সরগরম। আজকে আমরা জানবো- ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য কত হওয়া উচিত।

 

পুর্ববর্তী যুগে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের বিশাল পার্থক্য থাকা খারাপভাবে দেখা হতো না

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাতি হুসাইন (রা.)-এর স্ত্রী আতিকা বিনতে যায়িদ (রা.) ছিলেন তার চেয়ে প্রায় ২৬ বছরের বড়ো। যায়িদ ইবনে হারিসা (রা.)-এর স্ত্রী উম্মে আইমান (রা.) ছিলেন তার চেয়ে প্রায় ২০ বছরের বড়ো।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বয়স তখন ৫৫ বছর। তিনি বিয়ে করেন হযরত আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুম বিনতে আলি (রহ.) কে। হযরত ফাতিমা (রা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুমের বয়স তখন ১১ বছর। স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ছিলো ৪৪ বছর।

 

স্বামী-স্ত্রীর বয়সে বিশাল তারতম্যে বিয়ে জায়েজ হবে?

স্বামী-স্ত্রী সমবয়সী হওয়া কিংবা বয়সের তারতম্য থাকা- উভয় অবস্থায় বিবাহ বৈধ। দেশে দেশে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ব্যবধানেরও বহু নজির রয়েছে। ইসলামি শরিয়তে বয়সে পার্থক্যময় বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। আবার ইসলাম এ বিষয়ে কাউকে উৎসাহও দেয়নি। এ ক্ষেত্রে আছে প্রশস্ততা ও অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু বিষয়টি নির্ভর করে বাস্তবতা, সমাজ, সংস্কৃতি ও পরস্পর বোঝাপড়ার ওপর।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) তার চেয়ে বয়সে বড়। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে ১৫ বছরের বড়। হযরত খাদিজা (রা.) বংশমর্যাদা, সহায়-সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ছিলেন সমাজের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। তার জীবদ্দশায় প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করেননি। (ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা ৫৯)

স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি ছিল প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পালক পুত্র জায়িদ ইবনে হারিসা (রা.) ও তার স্ত্রীর। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লালন-পালনকারী বারাকাহ (রা.)। তার প্রসিদ্ধ নাম উম্মে আইমান।

জায়িদ ইবনে হারিসার চেয়ে তার স্ত্রী উম্মে আইমান (রা.) কমপক্ষে ৩০ বছরের বড় ছিলেন। উম্মে আইমান (রা.) ছিলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে পালক মা। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোলে-কাঁধে করে যারা বড় করেছেন, তিনি তাঁদের একজন।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে একদিন সাহাবায়ে কিরামকে বলেন, কেউ যদি জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চায় সে যেন উম্মে আইমানকে বিয়ে করে। জায়েদ (রা.) দেরি না করে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টির জন্য তাকে বিয়ে করেন। উম্মে আইমান (রা.) তখন বয়স্কা নারী। আর জায়েদ (রা.) অবিবাহিত যুবক। তার উদরে (মক্কায়) জন্মলাভ করেন বিখ্যাত সেনানায়ক উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)। (উসদুল গাবাহ ২/১৩০; আল-ইসাবাহ ২/৪৯৬)

স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ভারসাম্য রক্ষা করা

স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত। কারণ স্বামী-স্ত্রীর আচরণে বয়স অন্যতম প্রভাবক। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ عِنۡدَهُمۡ قٰصِرٰتُ الطَّرۡفِ اَتۡرَابٌ
(জান্নাতে) তাদের পাশে থাকবে সমবয়সী আয়তনয়না (জান্নাতি রমণী)। (সুরা সাদ, আয়াত: ৫২)

অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,

আমি জান্নাতি রমণীদের উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের করেছি চিরকুমারী, সোহাগিনী, সমবয়স্কা। (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ৩৫-৩৮)

হযরত জাবির (রা.) বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে জাবির! তুমি বিয়ে করেছো কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কেমন, কুমারী না অকুমারী? আমি বললাম, না (কুমারী নয়) বরং অকুমারী। তিনি বললেন, কোন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করলে না কেন? সে তো তোমার সাথে আমোদ-প্রমোদ করত।

আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার আব্বা উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। এবং রেখে গেছেন ৯টি মেয়ে। এখন আমার ৯ বোন। এ কারণে আমি তাদের সাথে তাদেরই মত একজন অনভিজ্ঞ মেয়েকে এনে একত্রিত করা পছন্দ করলাম না। বরং এমন একজন মেয়েকে (বিয়ে করা পছন্দ করলাম) যে তাদের চুল আঁচড়িয়ে দিতে পারবে এবং তাদের দেখাশোনা করতে পারবে। (এ কথা শুনে) তিনি বলেছেন, ঠিক করেছ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৫৬)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকেও বুঝা যায়, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাওয়া কুমারী নারীকে বিয়ে করা ও স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ভারসাম্য রক্ষা করা।

 

স্বামী-স্ত্রীর বয়সের বেশি ব্যবধানে দূরত্ব সৃষ্টি হয়

স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধানে ভারসাম্য প্রয়োজন। হযরত ফাতেমা (রা.)-কে বিয়ে করার প্রস্তাব সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রা.) দেন। অতঃপর হযরত ওমর (রা.) প্রস্তাব দেন। উদ্দেশ্য ছিল, তারা প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা হওয়ার সম্মান অর্জন করবেন।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে [ফাতেমা (রা.)] অনেক ছোট। তাঁদের বয়স অনেক বেশি ছিল। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়সের কথা বিবেচনা করে তাঁদের আবেদন নাকচ করে দেন।

মেয়ের বয়স কম হলে স্বামীর বয়স অতিরিক্ত বেশি হওয়া উচিত নয়। বয়সের বেশি অসমতায় বিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়। (ইত্তিহাফুস সায়েল বিমা লিফাতিমাতা মিনাল মানাকিবি ওয়াল ফাদাইল, পৃষ্ঠা : ৩৪-৩৬)

জান্নাতি নারীদের সর্দার হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ের সময় বয়স ছিল সাড়ে ১৫ বছর। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, পৃষ্ঠা : ৪২৩)। তবে ইবনে সাদের মতে, সে সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। আর বিখ্যাত সাহাবি হযরত আলি (রা.)-এর বয়স ছিল ২১, মতান্তরে ২৫ বছর। ইসলামে হযরত আলি (রা.) ও হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে একটি আদর্শ বিয়ে।

উপর্যুক্ত আলোচনায় বুঝা যায়, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত। উত্তম হলো, বয়স কাছাকাছি হওয়া। স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়স কিছু কম হওয়া। কারণ নারীর শারীরিক কাঠামো থাকে দুর্বল। ফলে সে আগে বৃদ্ধা হয়ে যায়। যদি স্বামীর বয়স স্ত্রীর থেকে দুই-চার বছর বেশি হয় তাহলে দাম্পত্য সম্পর্কে ভারসাম্য আসে।

 

আরও খবর

Sponsered content