সারাদেশ

সন্তানকে জমি লিখে দিয়ে শেষ বয়সে ঠাঁই হলো ‘বেলা শেষে’

সন্তানকে জমি লিখে দিয়ে শেষ বয়সে ঠাঁই হলো ‘বেলা শেষে’

পরপর দুইটি মেয়ে সন্তানের জন্মে খুশি হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের দুলালুর রহমান। বৃদ্ধ বয়সে ছেলে সন্তানরা ভাত কাপড় না দিলেও মেয়েরা বাবা মায়ের দেখভাল ঠিকই তো করবেন। স্ত্রীর বিয়োগে মেয়ে দুটি ছাড়া আপন কেউ যে আর রইলো না কৃষক দুলালের। শাশুড়ির পরামর্শে মেয়ে দুইটির নামে ভিটে মাটি জমি সব লিখে দিলেও নতুন করে আর সংসার পাতা হয়নি।

 

কিন্তু এত স্বপ্ন বুনেও শেষ বয়সের হিসাব মেলাতে পারেননি পঁচাত্তর বয়সী দুলাল। এখন তার ঠাঁই হয়েছে নড়াইল জেলা সদরের আলোকদিয়ার ‘বেলা শেষে’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু দুলাল নয়, তার মতো অনেকেরই জীবনের শেষ ভাগ কাটছে এখন এ ঠিকানায়— অপেক্ষার পথ চেয়ে।

মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে দূরপানে তাকিয়ে ভাবছেন ফোনটি কি বাজবে, কেউ কি আসবে নিতে! ভাই বোন মানুষ করতে গিয়ে নিজের চুলগুলোয় কখন যে পাক ধরছে সেটা টেরই পাননি যশোর কেশবপুরের পূর্ণিমা মণ্ডল।

এক ভাই ও চার বোনকে মানুষ করেছেন, সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ভাইটা খোঁজ নেয়া তো দূরে থাক, বয়স্ক ভাতাটাও তুলে খান! শেষ বয়সে এসে বুঝলেন নিজের জন্য ভাবা উচিত ছিল।

আশির কোটায় থাকা আরতি ধরের একটাই ছেলে, ঢাকায় কোনো এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। নাতিপুতি নিয়ে ভালই আছেন। একমাত্র ছেলের সম্মান বাঁচাতে একটু মিথ্যার আশ্রয়— ছেলে খোঁজ খবর রাখেন, কিন্তু ছলছল করা চোখ জোড়া কি আর মিথ্যা বলে? থাকতেন বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে, ছেলে নাকি তাকে অনেক খুঁজেছে!

আটাত্তর বছরের মুন্সী আব্দুল্লাহ মেহমানের উপস্থিতি দেখে গায়ে পাঞ্জাবি টা জড়ালেন, কিন্তু প্রথমবারেই পরলেন উল্টো, সেটা ঠিক করতে গিয়ে পেঁচিয়ে তার শ্বাসটাই যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নড়াইল সদরেই তার পরিবার কিন্তু কেউ খোঁজ রাখেন না।

এখানেই নাকি তিনি ভাল আছেন, সময় মত খেতে পারছেন, ঔষধ পাচ্ছেন। কেউ খোঁজ নিলো কি না তা দিয়ে কি হবে? এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়তো তার কষ্টে ভরা বুকটা হালকা করার মিছে ছলনা।

কিশোরগঞ্জের দুলাল, যশোরের পূর্ণিমাসহ নড়াইলের আরও পাঁচ জন নারী পুরুষ বয়সের পড়ন্ত বেলায় আশ্রয় নিয়েছেন জেলা সদরের আলোকদিয়ার ‘বেলা শেষে’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। থাকছেন খুবই আদরে, ভাল মানের খাবার খাচ্ছেন আর নিয়মিত চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছেন।

দোতলা বিশিষ্ট টালইস করা ঘরে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকেও যে বয়সটাতে থাকার কথা আপনজনের কাছাকাছি সে তৃষ্ণা মেটানোর সাধ্য কি আর প্রকৃতির আছে!

জানা যায়, ২০২২ সালের মে মাসে পারিবারিক উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি চালু করেন আইনজীবী দম্পতি অ্যাডভোকেট এ এফ এম হেমায়েৎ উল্লাহ হিরু ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। এ পর্যন্ত ৩২ জন ‘বেলা শেষে’ আশ্রয় নিলেও সামাজিক কারণে অনেকের পরিবার পরিজন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।

বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমটিতে তিন জন নারী ও চারজন পুরুষসহ মোট ৭ জন বয়স্ক মানুষ এখানে বসবাস করছেন। তাদের দেখভালের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে বেতনভুক্ত একজন সমাজকর্মী, একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ মোট পাঁচজন লোক রয়েছে।

সাতজনের গল্পটা যে সাত রকমের। প্রতিটা গল্পের শুরুটা ভিন্ন হলে শেষটা যে কষ্ট, হাহাকার আর চোখের জলে ইতি টানে। জীবন খাতার অঙ্কের হিসাবটা মিলাতে না পারা বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের গল্পগুলো প্রতিদিনই শুনছেন আর পরম যত্নে তাদের আগলে রাখছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেলা শেষে বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক সাবিনা ইয়াসমিন সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমার বাবা-মা হলে কি করতাম, তাদের তো সেবা যত্ন করতাম। সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই আমরা শুরু করেছি। এই বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যেই আমি আমার বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির চেহারা দেখি।

তাদের নিজ হাতে খাওয়াতে পারি এটা আমার পরম সৌভাগ্য। তাদের সন্তানরা ফেলে দিয়েছে, তাতে কি আমরা তো আছি। যতদিন বেঁচে আছি তাদের সেবা করে পরকালের জন্য কিছু পুঁজি নিয়ে যাই।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এফ এম হেমায়েৎ উল্লাহ হিরু বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পারিবারিক উদ্যোগে এটা করেছি। একটি বয়সে ধনী গরীব সবাই অসহায় হয়ে পড়েন, গল্প করার মত লোকটিও খুঁজে পান না তারা।

সরকার বয়স্ক ভাতা দিচ্ছেন, কিন্তু শেষ বয়সে পরিবার পরিজনের যে ভালবাসাটা দরকার সেটা ক’জনই বা পাচ্ছেন। আমি চাই না কেউ বৃদ্ধাশ্রমে থাকুক, কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন।

হিরু আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি যেন শুধু ইট পাথরের মধ্যেই আটকে না থাকে আমাদের অবর্তমানে যেন বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্য পারিবারিকভাবে খামারের আয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সরকারি সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে ভালভাবে চালানোর জন্য নিবন্ধন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার পর থেকে একটা জিনিস উপলব্ধি করছি, বয়স্কদের খাবার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার চেয়ে ঔষধ জরুরি। আর ঔষধের খরচটাই বেশি। বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাই যাকাতের অর্থের সহায়তা প্রতিষ্ঠানটিতে দিলে তাদের চিকিৎসা করাতে আমাদের সুবিধা হবে।

পূর্ণিমা, আরতি, দুলাল ও ওলিয়ার নিজেদের জীবন খাতার মিছে হিসাব কষতে গিয়ে অসমাপ্ত গল্পের শূন্যতে হয়তো বেলা শেষের চার দেয়ালের মাঝেই ইতি টানবেন। কিন্তু সন্তান হিসাবে আমরা পড়ন্ত বয়সে হিসাবটা মিলাতে পারবো তো! যেন সে কথাই বলছে এ বয়স্ক মানুষগুলোর ছলছল করা চোখ।

আরও খবর

Sponsered content