সারাদেশ

নামিদামি কোম্পানির মোড়কে তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর সেমাই

নামিদামি কোম্পানির মোড়কে তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর সেমাই

পবিত্র ঈদের ফিতুরকে সামনে রেখে কুমিল্লায় ধুম পড়েছে সেমাই বেচাকেনার। ফলে ঈদকে সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা বেড়েছে কুমিল্লার বিসিক শিল্প নগরীসহ জেলার প্রায় ২০টি সেমাই তৈরি কারখানায়।বিশেষ করে এ অঞ্চলের বাংলা সেমাইয়ের (চিকন সেমাই) সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। তবে সেমাই তৈরিতে কুমিল্লা অধিকাংশ কারখানা মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। স্যাঁতসেঁতে মেঝে, নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হওয়া এসব সেমাই বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচাতে কঠোর তদারকি প্রয়োজন বলে দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

 

জেলায় নামে-বেনামে বিভিন্ন কারখানায় ও সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেমাই উৎপাদন করে আসছে। প্যাকিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন নামিদামি ব্যান্ডের মোড়ক। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বিবির বাজার এলাকার কাশফুল ফুড প্রোডাক্টস, মেসার্স মক্কা কঞ্জুমার অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের মতো শহরের আনাচে-কানাচে ব্যাংঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব মৌসুমি সেমাই কারখানা।

 

জানা গেছে, প্রতিবছর রোজা শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকে সেমাই তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন এসব কারখানার মালিকরা, ঈদ উপলক্ষে এসব সেমাই তৈরি করে রমরমা ব্যবসা করেন তারা। কুমিল্লার চিকন সেমাই বেশি তৈরি হয় কুমিল্লার বিভিন্ন কারখানাগুলোতে। তবে ঈদের পর পর অধিকাংশ কারখানা মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নেন। অপেক্ষায় থাকেন পরের বছরের জন্য।

 

সোমবার (২৫ মার্চ) সরেজমিনে আর্দশ সদর উপজেলার বিবিরবাজার এলাকার কাশফুল ফুড প্রোডাক্টাস নামে একটি কারখানা গিয়ে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটি ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের সেমাই তৈরি করছে, তবে ব্যান্ডের বিভিন্ন কোম্পানির নামে তারা প্যাকেট করে বাজারজাত করছেন। আট থেকে নয়জন করে শ্রমিক কাজ করছেন।

 

তাদের দম ফেলার সুযোগ নেই। শ্রমিকদের কেউ ময়দার খামি তৈরি করছেন, কেউ বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রে সেমাই বানাচ্ছেন। আবার কয়েকজন শ্রমিক সেমাই কারখানার ছাদে নিয়ে বাঁশের মাচা তৈরি করে রোদে শুকাচ্ছেন।

 

স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সেমাই তৈরির কোনো চিত্র দেখা যায়নি সেখানে। নোংরা-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশেই সেমাই উৎপাদন, শুকানো ও প্রক্রিয়াজাত চলছে। কর্মব্যস্ত শ্রমিকদের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। আর ঘর্মাক্ত শরীরে কাঁধে করে এসব সেমাই রোদে শুকাতে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।

 

কাশফুল ফুড প্রোডাক্টাসের মতো নামে বেনামে জেলার মুরাদনগর, চৌদ্দগ্রাম, সদর দক্ষিণ, লাকসামে আরও ১০টি কারখানার একই চিত্র দেখা যায়, এসব সেমাই কুমিল্লার নগরীসহ ঢাকার ট্রাকে ভরে সেমাই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। কারখানাগুলো টুকরি হিসেবে সেমাই বিক্রি করে। প্রতিটি টুকরিতে ৩৫ কেজি সেমাই থাকে। প্রতি টুকরি ১ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

কারখানা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেমাইয়ের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তার ওপর শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। এক টুকরি সেমাই তৈরিতে গত বছর শ্রমিকরা ৯০ টাকা নিতেন। এখন নিচ্ছেন ১০০ টাকা।

 

সেই সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। আশপাশের বাজারে ভ্যানে চেপে সেমাই পাঠাতে প্রতি টুকরিতে খরচ পড়ত ২০ টাকা। বর্তমানে খরচ হচ্ছে ৩৫ টাকা। তাই বাংলা সেমাইয়ের দামও বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে প্রতি টুকরি সেমাইয়ে বেড়েছে ২০০ টাকা।

 

সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী এলাকার একটি সেমাইয়ের কারখানার ব্যবস্থাপক তানভীর হোসেন বলেন, ‘আগে বাংলা সেমাইয়ের খুব চাহিদা ছিল। তবে দিনকে দিন এই সেমাইয়ের চাহিদা কমে আসছে। তার ওপর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। করোনার আগেও এখানে ৫০টির বেশি কারখানা ছিল। সামলাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন কারখানার সংখ্যা ১০-১২ তে নেমে এসেছে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কারখানার শ্রমিক বলেন, আমাগো কারখানাগুলোতে সেমাই তৈরির জন্য এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দুই মাসের জন্য কারখানাগুলো সচল থাকে। ঈদ শেষে আবার এগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন রিকশা বা ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।

 

ক্যাব কুমিল্লার সভাপতি জহিরুল হক দুলাল বলেন, প্রতি বছর রমজান এলে বেনামি কিছু প্রতিষ্ঠান সেমাই তৈরি শুরু করে। অথচ এদের কোনো লাইসেন্স নেই। সেমাই তৈরি হয় যাচ্ছেতাই ভাবে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

 

আমরা এ বিষয়ে গত বছরও বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম। অথচ কোনো প্রতিকার মেলেনি। এসব সেমাই খেলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। কাজেই এমন অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলছি।

 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, গত বছরও আমরা চাক্তাই এলাকায় গড়ে ওঠা এসব কারখানায় অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরির প্রমাণও পেয়েছিলাম। তখন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছিল। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা এবারও বিষয়টি দেখব। অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।

 

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বিসিক শিল্পনগরীতে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে সেমাই তৈরি করা হয়। মনিটরিংয়ে কোনো অনিয়ম পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কুমিল্লার উপপরিচালক (সিএম) কেএম হানিফ বলেন, খোলা আকাশের নিচে সেমাই করা যাবে না। ফ্লোরে প্যাকেট করা যাবে না। কাঠের টেবিলে প্যাকেট করতে হবে। নোংরা পরিবেশে উৎপাদন করা যাবে না।

 

তিনি বলেন, মোবাইল কোর্টে বিএসটিআই’র সিএম লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত লাচ্ছা সেমাই পণ্যের মোড়কে ‘বিএসটিআই’র স্ট্যান্ডার্ড মার্ক ব্যবহার করার অপরাধে মেসার্স কাশফুল ফুড প্রোডাক্টকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

 

আরও খবর

Sponsered content