অর্থনীতি

মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ

মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ

শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্প্রতি ঘোষিত নতুন নীতির (স্মারক) লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যু্ক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি বা দিকনির্দেশনা নিয়ে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। উদ্যোক্তাদের উৎকণ্ঠার বিপরীতে বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছে না সরকার।

 

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, স্মারকে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এর ব্যবহার করতে পারে। শ্রম অধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে মনে করলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সুযোগ রয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর পড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয় চিঠিতে।

 

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজার লেখা চিঠিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠানো হয় ২০ নভেম্বর। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া স্মারকের সংকলিত একটি প্রতিবেদনও চিঠির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।

 

এর আগে গেল ১৬ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি বা দিকনির্দেশনা ঘোষণা করেন। সে সময় তিনি জানান, বিশ্বজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, শ্রমিক অধিকারের পক্ষের কর্মী, শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যে বা যারা হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করবে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য, ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যত ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে, তা প্রয়োগ করা হবে।

 

বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয় বাইডেন প্রশাসন। প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম রাষ্ট্রপতির স্মারকে সই করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ১৬ নভেম্বর সানফ্রান্সিসকোর একটি হোটেল শ্রমিক নেতাদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কল্পনা আক্তারের কথা স্মরণ করে বক্তব্যে তিনি বলেন, কল্পনা জানিয়েছেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং এ জন্য তিনি (কল্পনা) এখনও বেঁচে আছেন।

 

পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে কিংবা বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে এ খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হবে শ্রমিক। অথচ মার্কিন সরকার শ্রমিকদের স্বার্থেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। ফারুক হাসান আরও বলেন, আফ্রিকার অনেক দেশে শ্রমমান এবং শ্রম অধিকার চর্চা অত্যন্ত নিম্নমানের। অথচ ওইসব দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

বাংলাদেশ শ্রমিকদের অনুকূলে গত ১০ বছরে ৩ বার শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও করা হবে। তবে রাজনৈতিক কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্র এ রকম কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে উদ্যোক্তাদের করার কিছু নেই।

 

উদ্যোক্তাদের উদ্বেগের বিপরীতে গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমেরিকা-ইউরোপ মিলে পোশাক রপ্তানি বন্ধে যে পাঁয়তারা করছে, তা বাস্তবায়ন হবে না। রংপুরে মন্ত্রীর নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে টিপু মনুশি আরও বলেন, রাজনীতি ও ব্যবসা আলাদা জিনিস। ইউরোপ-আমেরিকা এমন কিছু করবে না, যার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পড়তে পারে।

 

এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হতে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেন তিনি। অন্যদিকে দূতাবাসের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ যোগাযোগের কাজ হিসেবেই দূতাবাসের পক্ষ থেকে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে। শ্রম অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের বক্তব্যের বিষয়টি জানিয়ে ওয়াশিংটন দূতাবাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বলে জানান তিনি।

 

জানতে চাইলে বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং গবেষণা সংস্থা র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, নতুন নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা, নিলে তা কী ধরনের হতে পারে– এখই তা বলা মুশকিল। আগামী ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একটা বিবৃতি দেবে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। তবে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে সরকারকে। কারণ, তারা পরাশক্তি। কোথায় কী ধরনের দুর্বলতা আছে তা শনাক্ত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

 

এ ব্যাপারে শ্রমিক নেত্রী ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার সমকালকে বলেন, মাকিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তায় শ্রম অধিকার হরণ বা লঙ্ঘন হলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্য এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ বা সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের কথা বলা হয়নি। তবে বাংলাদেশ এ শাস্তির আওতায় পড়লে তিনি অবাক হবেন না। কারণ এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা আছে।

 

শ্রমিকদের ‌ওপর হামলা-মামলা নতুন ঘটনা নয়। নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে তিন শ্রমিককে গুলি করে মারা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০টি মামলা হয়েছে শ্রমিকের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস আগে শ্রমিকদের বাঁচাতে গিয়ে শহিদুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক নেতা খুন হয়েছেন। এসব ঘটনা এবং আগে থেকে চলে আসা শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের লেবার অ্যাটাশে এসব বিষয়ে নজর রাখছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁর নাম উল্লেখ প্রসঙ্গে কল্পনা আক্তার বলেন, বিভিন্ন সময় নানা ফোরামে শ্রম ইস্যুতে আমি কথা বলেছি, তবে কবেকার কোন কথা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন তা আমার জানা নেই।

 

দূতাবাসের চিঠিতে কল্পনা আক্তারের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের স্মারক সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে বাংলাদেশ যে অন্যতম লক্ষ্যবস্তু তা বিশ্বাস করার মতো কারণ রয়েছে। স্মারক প্রকাশের অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে।

 

স্মারক অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশন শ্রম ইস্যুতে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারবে। এই নীতি অভ্যন্তরীণ অনেক ইস্যুতে মার্কিন কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করবে। তারা যদি মনে করে শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে– তাহলে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর এই নীতি আরোপ করার সুযোগ রয়েছে।

 

রাজনৈতিক প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, স্মারকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনেক সতর্ক হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এই স্মারকে শ্রম অধিকার প্রশ্নে যা বলা হয়েছে, এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার করতে পারে। স্মারকটি বাংলাদেশের জন্য একটি বার্তা। কারণ, স্মারক অনুযায়ী শ্রম ইস্যুর অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে।

 

চিঠিতে পোশাক খাত বিষয়ে বলা হয়, স্মারকের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপরও। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে সমজাতীয় পণ্যসহ পোশাক খাত থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে একক প্রধান বাজার। মোট পোশাক রপ্তানির ২০ থেকে ২২ শতাংশ যায় দেশটিতে। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩২ শ্রমিক নিহত হন। দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিবেশ না থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কখনই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার আওতায় ছিল না। এরপর ১৬ দফা সংস্কার পরিকল্পনা দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে। এর প্রায় সবগুলোই পরিপালন করা হলেও জিএসপি সুবিধা আর বহাল করা হয়নি।

 

আরও খবর

Sponsered content