অর্থনীতি

জীবনের ওপর প্রভাব পরেছে টাকার মান কমে যাওয়ায়

জীবনের ওপর প্রভাব পরেছে টাকার মান কমে যাওয়ায়

ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কমানোর পর থেকে প্রতিদিনই কমছে টাকার মান, বাড়ছে ডলারের দাম। এতে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা সীমিতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানিকারকরা। সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভোক্তারা। টাকার মান কমে যাওয়ায় ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। বাড়ছে পণ্যের দাম। সব মিলে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। আর এটা দিন দিন বেড়ে জীবনের ওপর নানা রকমভাবে প্রভাব ফেলছে।

 

টাকার মান নির্ধারণ হয় টাকার ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে। দ্রব্যের দামের সাথে টাকার মানের সম্পর্ক বিপরীত। দ্রব্যের দাম কমলে টাকার মান বাড়ে, বিপরীত-ক্রমে দ্রব্যের দাম বাড়লে টাকার মান কমে। যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থের আন্তর্জাতিক মূল্যের নির্ধারিত হয় তার যোগান এবং চাহিদার ওপরে নির্ভর করে।

 

রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে আশা জাগালেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে টাকার মানও। ডলার বাঁচাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। যদিও মূলধনই যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও তা নিষ্পত্তির হার কমে গেছে। এতে উৎপাদন খাত শিথিল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেই চলেছে।

 

টাকার মান কমে যাওয়াতে জনসাধারণের ওপর বেশ প্রভাব পড়ছে। এরকমই কয়েকজনের সাথে আমরা কথা বলে তাদের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করেছি।

 

তাদেরই একজন গ্রাফিক ডিজাইনার সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে। ডলারের দাম বাড়ার আগে বা টাকার অবমূল্যায়নের আগে যে পরিমাণ উপার্জন করতাম এখনো তাই করছি। আমরা চাইলেই আগের মতো একই পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবা কিনতে পারছি না। ডলারের দাম বৃদ্ধি মানেই নিজস্ব মুদ্রার দাম কমে যাওয়া।

 

ডলারের দাম বেড়ে গেলে বেশি খরচে অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয়। তেলের দাম বাড়লে শাকসবজি, ভোজ্য তেল ও খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহন খরচও বেড়ে যায়। ফলে, সেসব পণ্যের দামও বাড়ে। এটি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে।

 

এটি দেশকে মূল্যস্ফীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরিশোধিত তেলের জন্য অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হচ্ছে বলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

 

এসব কারণেই আমাদের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলোতে বিদেশি পণ্য ব্যয়বহুল হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি বা টাকার দরপতন বিদেশি শিক্ষা ও ভ্রমণকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলছে। টিউশন ফি ও ফ্লাইটের টিকিট ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এজন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

 

জুরাইনের বাসিন্দা ডা. রুখশাদ রাব্বি অনয় বলছেন, আগে আমার গাড়ির অকটেন ছিল ৯৫ টাকা, এখন ১৩০ টাকা। জ্বালানি খরচ বেড়েছে, গাড়ির ট্যাক্স বাড়িয়েছে, তাই আমার ট্রান্সপোর্ট খরচ অনেক বেড়েছে। পানি বিল, বিদ্যুৎ বিল বাড়ায় আমার বাসা ও চেম্বারের মেইনটেনেন্স খরচ বেড়েছে। স্টাফদের বেতন বাড়াতে হয়েছে। কারণ বাজারের সবকিছু দুই-তিনগুণ দাম বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এজন্য আগে যে ইনকাম করার পর কিছু টাকা সঞ্চয় হতো, এখন আর তা হচ্ছে না।

 

লালবাগের বাসিন্দা আবু হুরায়রা বলছেন, টাকার মান কমে যাওয়ায় সব দিকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ব্যবসায়িক দিকে বলেন আর চাকরির দিকে বলেন, সবাই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। আমি ছোট-খাটো চাকরি করি। মাসিক যে বেতন পাই এতে আমি নিজে একাই চলতে পারছি না, আর পরিবারের সাথে সেই টাকা দিয়ে কীভাবে সাহায্য করবো। বাসে চলাফেরা করে বাড়ি ভাড়া দিয়েই সম্পূর্ণ বেতন খরচ হয়ে যায়।

 

তিনি আরও বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের যে পরিমাণে দাম বেড়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। যে কোন কাচা সবজি ৮০ টাকা কেজির নিচে নেই। বেঁচে থাকার জন্য যে আলু ভর্তা, ডিম দিয়ে ভাত খাবো- সেটাও মনে হচ্ছে আর খাওয়া সম্ভব না।

 

লবণ আর পানিভাত খেয়ে কোন রকম জীবন বাঁচিয়ে রেখেছি। মাছ মাংসের কথা তো চিন্তাই করতে পারি না, খাবো তো দূরের কথা। এই মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে চিকিৎসা করার মতো সেই টাকাও নেই।

 

কমেই চলেছে টাকার মান

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। এরপর পাঁচ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা সাড়ে ৮ টাকার মতো দর হারায়।

 

আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের আগস্টে ডলারের আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৫ সালের আগস্টে এই দর বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৬ সালের আগস্টে ডলারের দর ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৭ সালের আগস্টে ডলারের দর বেড়ে হয় ৮০ টাকা ৭০ পয়সা। ২০১৮ সালের আগস্টে ডলারের দর ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা হয়।

 

২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ডলারের দর একটু একটু করে বেড়ে আবার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় উঠে আসে।

 

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। জুনে ওই দর ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। এরপর থেকে ডলারের দর চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৮৪ দশমিক ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন (দুই হাজার ৪৭৮ কোটি) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

 

২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৩৬৮ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ কম।

 

অন্যদিকে মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন (তিন হাজার ৮৭৬ কোটি) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন (ছয় হাজার ৫৬০ কোটি) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০২২-এ বলা হয়েছে, ২০২২ সালে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার এই অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে।

 

ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২ জানুয়ারি ডলারের আন্ত-ব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা ১ ডিসেম্বর দাঁড়ায় ১০৫ টাকা ৪০ পয়সায়। মূলত করোনা মহামারির পর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও খারাপ হয়।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি, জাপানি ইয়েন এবং ইন্দোনেশিয়ান রুপিসহ প্রধান আমদানি দেশগুলোর মুদ্রার উল্লেখযোগ্য দরপতন হয়েছে। পাকিস্তানি রুপির ২২ শতাংশ দরপতন হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাপানি ইয়েনের দরপতন হয়েছে ১৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর ৬ শতাংশ এবং ইউকে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের ১০ শতাংশ দরপতন হয়েছে।

 

তবে ব্যতিক্রম ছিল রাশিয়া ও সিঙ্গাপুরের। ২০২২ সালে রাশিয়ান রুবল ও সিঙ্গাপুরি ডলারের দর বেড়েছে যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ১ শতাংশ।

 

সর্বশেষ আগস্ট মাসের শুরুতে রিজার্ভ থেকে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই মাস না যেতেই তৃতীয়বার টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৯ টাকা। সবমিলিয়ে গত ১ বছরে দেশে টাকার পতন হয়েছে ১৫ টাকা ৫ পয়সা। এক বছর আগে ডলার রেট ছিল ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। সেই থেকে টাকার অবনমন ঘটেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।

 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার এতো বেশি অবমূল্যায়ন অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, বিনিময় হার শক্তিশালী না হলে বৈদেশিক ঋণও কমে যাবে এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে।

 

আমদানিও ব্যয়বহুল হবে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল দুই বছর আগেই ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো। কিন্তু তখন তা করা হয়নি। এর ফলে এখন অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খেতে পারছে না।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, এখন প্রতি ডলারে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। রেমিট্যান্সে দেওয়া হচ্ছে ১০৯ টাকা। আর আমদানিতে লেনদেন হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।

 

গত বছর জুলাইয়ের শেষে মোট রিজার্ভ নেমে যায় ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে। যদিও এখন সেটি আরও কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নিয়মে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৩২৬ কোটি (২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন) ডলার।

 

গত ৯ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার (২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার। তবে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রকৃত রিজার্ভে ৬২৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই প্রকৃত রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে।

 

টাকার মান কমলে সমস্যা কোথায়

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকলে ঋণ পরিশোধে সরকারের চাপ বাড়বে। এতে বাড়বে ভর্তুকির পেছনে ব্যয় ও প্রকল্পের ব্যয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১২ সালের জুন শেষে দেশে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮১ দশমিক ৮৭ টাকা।

 

২০২১ সালের জুন শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা। এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয় মাত্র ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ডলারের দাম বাড়ায় ইতোমধ্যে সরকারের আর্থিক বোঝা বেড়েছে। শুধু তাই নয়, মূল্যস্ফীতিও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সেই ভর্তুকি বাড়িয়ে ৫০ হাজার ৯২৬ কোটি-টাকা করা হয়েছে।

 

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সম্ভাব্য ভর্তুকির জন্য বাজেটে ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান যদি এক টাকা কমে, তাহলে আগামী বছর শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ভর্তুকি ৪৭৪ কোটি টাকা বেড়ে যাবে।

 

টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরকারের প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে বিবৃতিতে বলা হয়, অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে বড় (মেগা) প্রকল্প আমদানিপণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভাবে টাকার মান কমলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে। একই কারণে সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে।

 

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তা-যুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। পরের দুই অর্থবছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৬০০ ও ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলে চলতি অর্থবছর শেষে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তা-যুক্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪০ হাজার ২০০ কোটি ডলার।

 

বাংলাদেশে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণ

কোনো দেশের মুদ্রা বা টাকার মান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ইনফ্লেশন (মুদ্রাস্ফীতি)। এটি একটি দেশের এমন অবস্থা প্রকাশ করে যখন পণ্যর দাম বেড়ে যায় এবং মানুষ বেশি অর্থ খরচ করে। উদাহরণস্বরূপ, পূর্বে আপনি ১ কেজি পরিমাণের কোনো পণ্য যত টাকা দিয়ে ক্রয় করতেন আজ সেই পণ্যের পরিমাণ আগের মতো থকলেও এর দাম দ্বিগুণ হয়েছে, যার মানে টাকার মূল্য কমে গেছে।

 

অর্থনীতিবিদ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মাদ মাসুদুল হাসান বলেন, টাকার মান কমে যাওয়ার কারণ কি এটা যদি আমরা বলি, তাহলে কিন্তু এটা নানাভাবে হতে পারে। কোনো সময় কোনো কারণে উৎপাদন যদি কমে যায় আর চাহিদা যদি আগের মতো অথবা বেশি বেড়ে যায়, তাহলে চাহিদা আর উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান থাকে। সেই ব্যবধানের কারণেও দেখা যায় যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে বিপরীতভাবে টাকার মান কমতে থাকে।

 

এটা যেমন দেশীয় কারণে হতে পারে আবার বৈশ্বিক কারণেও হতে পারে। যেমন বর্তমানে আমরা জানি বিশ্বব্যাপী যে সমস্যা চলছে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বা আরও অন্যান্য দেশে যে মেরুকরণ হয়েছে, সেসব কারণে আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

 

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি তার রপ্তানি বাড়াতে চায় তাহলে সে আবার অবমূল্যায়ন করতে পারে। অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ রেট যেটা থাকে সেই এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে বিনিময়ের যে হার, সে হারটা যদি পরিবর্তন করে অর্থাৎ অবমূল্যায়ন করেম, তাহলে তখন দেখা যায় একই টাকা দিয়ে আমরা বিদেশ থেকে যে জিনিসগুলো আনতাম সেগুলোর খরচটা বেড়ে যায়। যদিও সেখানে রপ্তানিটা আগে থেকেই একটু বেড়ে যায়।

 

তাতে হয়তো রপ্তানি-বাবদ আয়টা একটু বাড়ে। কারণ বিদেশিদের কাছে তখন দেশীয় দ্রব্যের জিনিসপত্রের দামটা একটু বেশি পাওয়া যায়। এটার সুফল বেশি নির্ভর করে ওই দেশের আমদানি বেশি নাকি রপ্তানি বেশি তার ওপর।

 

আমাদের দেশে আমদানি তো অনেক হয়, রপ্তানিও করি। কিন্তু দেখা যায় আমদানির কারণে যে সমস্ত দ্রব্য আমরা আনি সেগুলোর মূল্য বা খরচ অনেক বেশি হওয়াতে আমাদের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব পড়ে। কারণ অনেক বেশি দাম দিয়ে তখন আমাদেরকে জিনিস কিনতে হচ্ছে।

 

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওনক আরা পারভীন বলছেন, ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার সর্বোচ্চ পতন ঘটেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হওয়ার পেছনের কারণ হলো আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া। কিন্তু এর বিপরীতে রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয় তেমন বৃদ্ধি পায়নি।

 

যে কারণে ডলারের ঘাটতি থেকে যাওয়ায় টাকার মান কমছে। বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা যত আয় করছে, তার চেয়ে ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। কেননা কমেছে রেমিট্যান্স ও বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ফলে ডলারে টান পড়েছে। আর এতেই কমছে টাকার মান।

 

টাকার মান কমে যাওয়ায় জীবনে পড়া প্রভাবের সমাধান কী

অর্থনীতিবিদ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মাদ মাসুদুল হাসান বলেন, এর সমাধান আসলে অনেক জটিল। বিশেষ করে বৈশ্বিক যদি কোনো সমস্যা হয় সেটা পরিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না। তারপরেও দেশীয় যে বিষয়গুলো থাকে সেগুলোর ক্ষেত্রে একটা প্রধান উপায় হচ্ছে- উৎপাদন বাড়ানো। যদি আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারি অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত যে সমস্ত চাহিদা আছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে আমাদের যে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে একটা ব্যবধান থাকে সে ব্যবধান যদি কমে আসে তাহলে অনেক সময় টাকার মানটা আগের থেকে একটু বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

একটা দেশে যদি আয় বৈষম্য থাকে এবং সে আয় বৈষম্য যদি আমরা কমাতে পারি তাহলে অনেক সময় দেখা যায় টাকার মান বর্তমানের থেকে একটু ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। যে টাকাটা জনগণের কাছে আছে সেটা যদি সঠিকভাবে সঠিক স্থানে অর্থাৎ উৎপাদনমুখী কোন কাজে ব্যবহার করা যায় তাহলেও কিন্তু টাকার মান বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া সরকারকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। সেই ক্ষেত্রে তাকে টাকা ছাপাতে হয়। অথবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ঋণগুলো নিতে হয়, সে ঋণগুলোর কারণে দেখা যায় অনেক সময় জনগণের হাতে টাকা বেশি চলে আসে। ফলে দেখা যায় যে, আগের থেকে দাম স্তরটা বৃদ্ধি পায়।

 

তিনি আরও বলেন, আমরা জানি আর্থিক নীতি সরকারের যেটা থাকে সেগুলো যদি সে একটু সঠিকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে বা যথাসময়ে যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে অনেক সময় দাম স্তরটা একটু হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও আমারা জানি দাম স্তর বাড়লে আবার উৎপাদনকারীরা খুশি হয়। কারণ তারা উৎপাদন করার পরে তাদের দ্রব্য বিক্রি করার সময় বেশি অর্থ পায়। কিন্তু সেটারও একটা সীমা থাকা উচিত।

 

কিন্তু দেখা যায়, তখন যে পরিমাণ অস্থিরতা থাকে তারাও আসলে বিব্রত হয়ে যায় যে, কি হবে না হবে। যখন টাকার মান কমে যায় তখন কিন্তু মানুষের চাহিদা কমে যাবে, কারণ তাদের কেনার সামর্থ্য হ্রাস পাবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সমাধান আসলে এককথায় বলা যাবে না। তবুও সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যদি সরকার আরও একটু কঠোর হয় যে, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তাহলে আমরা আশা করি অবশ্যই বাংলাদেশ বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোর সমাধান করে টাকার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

 

সূত্র: ইত্তেফাক 

আরও খবর

Sponsered content