সারাদেশ

প্রেম ও বিয়ের ফাঁদে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ‘সর্বনাশ’

প্রেম ও বিয়ের ফাঁদে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ‘সর্বনাশ’

ফেসবুকের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের পরিচয়। সেই ফেসবুক মেসেঞ্জারের ভিডিও কলেই বিয়ে। এরপর স্বামী দাবি করে ঢাকায় দেখা করতে বাধ্য করে ভুক্তভোগী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে। পরে তাকে ঢাকা থেকে বরিশালের বিভিন্ন রিসোর্টে রাখে অভিযুক্ত চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক খান। সেখানে ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কৌশলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন তিনি। তারপর থেকে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীকে দীর্ঘ ছয় বছর নির্যাতন এবং ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক লোন করে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল রাজ্জাক।

 

সর্বশেষ ভুক্তভোগী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট (সিএমএম) আদালতে যৌতুক ও পারিবারিক সহিংসতা আইনে দুটি মামলা করার পর বিষয়টি সামনে আসে। এছাড়া রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি প্রাণনাশের হুমকি ও প্রতারণার অভিযোগে সাধারণ ডাইরি (জিডি) করেছে ভুক্তভোগী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

 

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে প্রথমে বিয়ের নাটক সাজিয়ে অন্তরঙ্গ হয় চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক। পরে তিনি খুলনার একটি কাজী অফিস থেকে ৫০ হাজার টাকার দেনমোহর দিয়ে কাবিনও করেন।

 

তবে বিয়ের শর্তই ছিল, এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কখনও সংসার এবং সন্তান চাইতে পারবেন না। কারণ রাজ্জাকের ঘরে রয়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তান। এ ছাড়া তিনি জামায়াত ইসলামির নেতা পরিচয়ে চট্টগ্রাম একটি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালকের পদও আঁকড়ে রয়েছেন।

 

ভুক্তভোগী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, রাজ্জাকের বাড়ি বরিশালে। তারা পরিবারসহ দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির এক নাম্বার গেটের পাশে নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করে আসছে। জামায়াত–শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রামে একবার হামলার শিকারও হন তিনি।

 

তারপর থেকে চট্টগ্রাম শহরেই থাকেন। গ্রামে তেমন একটা যান না। বগুড়া মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ও সংঘর্ষে একাধিকবার হামলা শিকার হয়েছেন। সেখানে ছাত্র শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয়।

 

তিনি সমকালকে বলেন, ২০১৭ সালে ৫ জুন ‘ডা. আব্দুর রাজ্জাক খান’ নামে ফেসবুকে একটি বন্ধুত্বের অনুরোধ আসে। চিকিৎসক দেখে বন্ধুত্বের আবেদন গ্রহণ করি। গ্রুপ ভিত্তিক পড়াশোনার করার কথা বলে বন্ধুত্বের অনুরোধ করে।

 

এরপর মেসেজে কথা হওয়ার একপর্যায়ে ফোন নম্বর নেয়। এর মধ্যে পরিচয়ের সাত দিন পর ১২ জুন ভিডিও কলে কথা বলার আবদার। এভাবে দুই মাস কথা হওয়ার পর হঠাৎ একদিন বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে রাজি না হলেও তার জোরাজুরিতে রাজি হই। তখন অপরিচিত দুজনকে সাক্ষী বানিয়ে ভিডিও কলে বিয়ে করে।

 

ভুক্তভোগী বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ৩১ জুলাই ঢাকায় আসে রাজ্জাক। ওই সময় জোর করে গোপালগঞ্জ ডেকে নেয়। সেখান থেকে বরিশালে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে তিনদিন রাখে। ঢাকায় ফেরার পথে বলে ‘আমাদের এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ দেখা’।

 

রাজ্জাক মাঝে মধ্যে ঢাকায় দেখা করতে আসার একপর্যায়ে হোটেল ও রির্সোটে উঠতে সমস্যা হয় দেখে সংসার ও সন্তান না চাওয়ার শর্তে ১৪ অক্টোবর খুলনায় একটি কাজী অফিসে নিয়ে রেজিস্টার করে। এরপর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়, ওই সময় তার প্রথম স্ত্রীর কথা জেনে যাই। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় চুপচাপ সব কিছু মেনে নেই। আমার (ভুক্তভোগী) বাবা চট্টগ্রামে রাজ্জাকের বাসায় গিয়ে বিষয়টি জানালে তারা মেনে নিবে না বলে জানিয়ে দেয়।

 

তারপর থেকে বিভিন্ন রির্সোটে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধর করত বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি মারধর করে ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন কক্সবাজার একটি হোটেলে মারধরের একপর্যায় ফেলে রেখে চলে যায়। পরে এক বান্ধবীর সহযোগিতায় কক্সবাজার থেকে গোপালগঞ্জে ফিরে আসলে আবার যোগাযোগ শুরু করে রাজ্জাক। পরে ওই বছরের ১৮ জুন চট্টগ্রামে তার কাছে চলে যেতে বলে।

 

এর এক মাস পর ১২ জুলাই রাজ্জাক আমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে একটি বাসায় উঠে। এ নিয়ে তার প্রথম স্ত্রী ঝামেলা শুরু করলে ২দিন পর চলে আসতে চাই। কিন্তু সেই বাসায় জিম্মি করে মারধর শুরু করে। এ ছাড়া তালাক দেওয়া ভয় দেখিয়ে খালি স্ট্যাম্পে তার ইচ্ছামতো কথা লিখিয়ে নেয়। তার মধ্যে কখনও তার স্ত্রী দাবি করতে পারবো না কথাও লিখিয়ে নেয়।

 

এরপর শুরু হয় রাজ্জাকের দ্বিতীয় ধাপের প্রতারণা। স্ট্যাম্প লিখে নিয়ে আবারও ভালো ব্যবহার আর সময় দিতে শুরু করে। এরমধ্যে বিসিএস–স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করে ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে কুমিল্লায় চলে যায়। ওই সময় রাজ্জাকের বান্ধবী পরিচয় দিয়ে চিকিৎসক নাদিয়া ফারহানা তার জীবন থেকে সরে যেতে বলে। এছাড়া তার পরিবার মেনে নিবে না বলেও জানায়। নাদিয়ার কাছে তাকে স্বামী বলে দাবি করি। একথা রাজ্জাক শুনে খুবই ক্ষেপে যায়। একপর্যায়ে প্রথম স্ত্রীকে দিয়ে মামলা এবং চাকরিতে সমস্যা করবে বলে হুমকি দিতে থাকে।

 

ভুক্তভোগী ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার মহাখালী হোটেল জাকারিয়াতে দেখা করার জন্য বলে। সেখানে দেখা করার পর ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক লোন করে অর্থ দিতে বলে। এই টাকা ব্যাংক ঋণ করে দিলে রাজ্জাক আমার সঙ্গে ঢাকায় বাসা নিয়ে থাকবে বলেও জানায়। এতে রাজি না হওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর হোটেলে আবার মারধর করে। তালাক দিয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়।

 

ওই মারধরের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২দিন চিকিৎসা নিতে হয়। কদিন পর হঠাৎ করেই ১৮ জানুয়ারি আইনজীবীর মাধ্যমে তালাক পাঠায়। কিন্তু তালাক পত্র হাতে আসে ২৮ জানুয়ারি। তালাক পাঠিয়ে মালেশিয়ায় যাওয়ার নাটক করে আত্মগোপন করে। এছাড়া নাদিয়ার মাধ্যমে জানায়, আইনের আশ্রয় নিলে আমার (ভুক্তভোগীর) সব ছবি বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দিবে।

 

রাজ্জাকের স্ত্রী চিকিৎসক উম্মে শারমিন বলেন, ‘আমার স্বামী রাজ্জাকের সঙ্গে ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অবৈধ সম্পর্ক ও বিয়ের বিষয়টি জানতাম। তবে আমি তাদের কিছুই বলেনি। মেয়েটা নিজের দোষে সংসার করতে পারেনি। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তার স্ত্রী বলেন, ছাত্র জীবনে স্বামী রাজ্জাক এলাকায় ও বগুড়া মেডিকেলে কলেজে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। তবে এখন তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না।

 

এ বিষয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক খান সমকালকে বলেন, ‘দ্বিতীয় স্ত্রী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয়ের পর ফোন কলে বিয়ে করি। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার জন্য তাকে তালাক দিয়েছি। এ সময় ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণের কথাও অস্বীকার করে বলেন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজেই ফ্ল্যাট কেনার জন্য আমার সঙ্গে ওটা নিয়ে পরামর্শ করে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।

 

ভাটিয়ারীর ইউপি সদস্য সাব্বির আহমেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘রাজ্জাকরা পরিবারগত ভাবে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা এলাকায় কারো সঙ্গে মিশে না তেমন। গ্রামের বাড়িতে তার বড় ভাই ও বাবা থাকেন। ১৯৯২ সালে তাদের বাসায় মিটিং করার সময় রাজ্জাককে স্থানীয়রা মারধর করেন। তারপর থেকে এলাকায় তেমন যান না তিনি।

 

আরও খবর

Sponsered content