বিনোদন

ময়মনসিংহে বিনোদন প্রেমীদের প্রধান কেন্দ্র যে গার্ডেন

ময়মনসিংহে বিনোদন প্রেমীদের প্রধান কেন্দ্র যে গার্ডেন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেতরে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনটি শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য এনে দিয়েছে তাই নয়, এর মাধ্যমে পুরো ময়মনসিংহ শহরে সৃষ্টি হয়েছে নতুন মাত্রা। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে ওঠা গার্ডেনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনোদনের পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসু ও স্থানীয় বিনোদনপ্রেমীর প্রধান কেন্দ্র।

 

বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদরাজিকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ এবং তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ওসমান গণির হাত ধরে ২৫ একর জমি নিয়ে গার্ডেনটি যাত্রা শুরু করে।

 

আন্তর্জাতিক সংস্থা বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল (বিজিসিআই) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি। তাই তো এ গার্ডেনটিকে একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে। যা বিমোহিত করে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।

 

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীদের কেউ কেউ গার্ডেনের ফটক দিয়ে বের হচ্ছেন, আবার কেউ কেউ টিকিট কেটে প্রবেশ করছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে এসে গার্ডেনের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছুয়ে দেখছেন আকর্ষণীয় গাছগুলো। ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের অপরিচিত নানা ধরনের গাছের নাম বলে চিনিয়ে দিচ্ছে বড়রা। আবার সবুজ ঘাসের উপর বসে গল্পে-আড্ডায় মেতেছেন অনেকে। সবমিলিয়ে আনন্দে মেতেছে সবাই।

 

গার্ডেনটি পরিচালনার জন্য ভেতরে রয়েছে দুইতলা অফিস কক্ষ। অফিসকক্ষ-সংলগ্ন নিসর্গ ভবনের ভেতরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় অসংখ্য প্রজাতির ক্যাকটাস। বাগানের সর্ব দক্ষিণের রয়েছে মনোরম অর্কিড হাউস। তবে দেবদারু গাছ বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

 

হাফিজুর রহমান নামে একজন দর্শনার্থী বলেন, আমি মুক্তাগাছা পৌর এলাকায় ব্যবসা করি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে এখানে এসেছি। বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের বিরল সংগ্রহশালা এই বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়েছি।

 

ফাহমিদা আক্তার নামে আরেকজন বলেন, অনিন্দ্যসুন্দর আর নানা উদ্ভিদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা বোটানিক্যাল গার্ডেনটি অনেকবার দেখেছি। যখনই স্বামীর বাড়ি ময়মনসিংহ নগরীর শম্ভুগঞ্জ থেকে বাকৃবিতে ঘুরতে আসি, তখন এই গার্ডেনে প্রবেশ করি। যতবারই এটির সৌন্দর্য দেখি, ততবারই মুগ্ধ হই।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে এখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অঞ্চলের বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় কয়েক হাজার উদ্ভিদের বিশাল সম্ভার। এখানে রয়েছে ৬০০ প্রজাতির প্রায় ১০০০টি বড়, ১২৭৮টি মাঝারি ও ৪৪৬৭টি ছোটসহ প্রায় ৬৭৪৫টি গাছ।

 

বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্যে উদ্ভিদরাজি সমন্বয়ে গঠিত গার্ডেনটি ৩০টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। ঔষধি, ফুল, ফল, ক্যাকটাস, অর্কিড, পাম, সাইকাস, মসলা, টিম্বার, বাঁশ, বেত, বিরল উদ্ভিদ ও বনজ উদ্ভিদ জোনসহ জলজ উদ্ভিদ (হাইড্রোফাইটিক) সংরক্ষণের জন্য ওয়াটার গার্ডেন, মরুভূমি ও পাথুরে অঞ্চলের উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য রক গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছে।

 

নগ্নবীজি উদ্ভিদ-১ ও পামবাগান জোনে মনিরাম, সাইকাডস, ডাইগুন, জ্যামিয়া, এনসেফালটরসসহ ১২ প্রজাতির নগ্নবীজি উদ্ভিদ এবং তালিপাম, সাগুপাম, মাতালপাম, চাউগোটা, বনগুয়া, চায়নাপামসহ ৩২ প্রজাতির পাম জাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নগ্নবীজী উদ্ভিদের আরেকটি জোনে অরোউকোরিয়া, থুঁজা, ঝাউ, পাইন, পডোকার্পাস, জুনিপেরাস ঝাউ গাছসহ ১০ প্রজাতির উদ্ভিদ এই জোনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

 

এখানে রয়েছে চা ও কফি বাগান। সেখানে বিটি ১, বিটি ২, বিটি ৩, বিটি ৭, টিভি ১, টিভি ৫-সহ বিভিন্ন চায়ের জাতের সংরক্ষণ এখানে রয়েছে। বাংলাদেশকে পরম মমতায় আগলে রাখা সুন্দরবনের গাছের জন্যে রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী সুন্দরবন জোন।

 

এসব উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন ঠিক তেমন করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র। শ্বাসমূল (নিউমেটাফোর) ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা এখানে সংরক্ষিত। সুন্দরবনের সুন্দরি গাছও এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে গরান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্ন জাতীয় নানা প্রজাতির উদ্ভিদ।

 

ঔষধি গাছের জোনে রয়েছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, গন্ধভাদুলি, পুনর্নভা, কুর্চি, বচ, উলটচন্ডাল, অন্তমূল, অঞ্জন প্রভৃতি ঔষুধি গাছ। এছাড়াও রয়েছে কমব্রিটাম, রনডেলেসিয়া, পালাম, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, ট্যাবেবুঁইয়া, রাইবেলি, জেসিয়া, ডায়ান্থাস, সিলভিয়া, হৈমন্তি বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ এবং স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, থাই মালটা, আঙুর, প্যাসান ফলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। বাঁশবাগানে রয়েছে ১৬ প্রজাতির বাঁশ, মসলা জোনে রয়েছে একশর বেশি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ।

 

এই গার্ডেনে রয়েছে নাগলিঙ্গম নামের একটি অপরিচিত বৃক্ষ। এটি সাধারণত কাঠবৃক্ষের মতো হলেও অন্য জাতের গাছের মতো এর শাখায় নয় বরং ফুল ফোটে গুঁড়িতে। এ ফুল সচরাচর দেখা যায় না। নয়নকাড়া ফুল আর বিচিত্র গোলাকার ফলের মনকাড়া সৌন্দর্য বিমোহিত করে সবাইকে। এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনাঞ্চলে।

 

রাজ-অশোক, ডেফল, কালাবাউস, ক্যারিলিম্ফ, ফলসা, মনহোটা, মাক্কি, পেয়ালা, বনভুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, টেকোমা, বহেরা, হরতকি, কাটাসিংড়া, ম্যালারিউকা, প্যাপিরাস, রাইবেলি, রুপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টোফোরামসহ বিভিন্ন বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ এখানে অত্যন্ত রক্ষণশীল উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

বিরল প্রজাতির হার্ব জাতীয় ঔষধি ও সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানকার পট হাউসে। এখানকার ঔষধি জোনে রয়েছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ। এরমধ্যে আপাং, পেটারি, বাসক, উচান্টি, ঈশ্বরমূল, রইনা, দাঁদমর্দন, হুরহুরিয়া, মূতা, কালাহুজা, অতশি, স্বর্ণলতা, চাপড়া, হরিনা, আসামলতা, জির, উলটচন্ডাল, ফলসা, তোকমা, জ্যাট্রোফা, লাল রিয়া, মহুয়া, নাগকেশর, জয়ত্রী, কালিজিরা, রক্তচিতা, সর্পগন্ধা, দুধকরচ, ইন্দ্রযব প্রভৃতি।

 

বাগানের পূর্ব দিকের সীমানাঘেঁষে ২০১০ সালে নির্মিত হয় একটি ক্যাকটাস হাউস। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ৬০ এর অধিক প্রজাতির ক্যাকটাস নিয়ে সাজানো হয়েছে হাউসটি। ক্যাকটাস এক ধরনের ফণীমনসা জাতীয় উদ্ভিদ। ক্যাকটাসের পুরো দেহ থাকে কাঁটায় আচ্ছাদিত।

 

এছাড়া এখানে রয়েছে একটি নার্সারি। শোভা বর্ধনকারী, অর্কিড, ক্যাকটাস, দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিসহ বিভিন্ন ফুলগাছের চারা এখান থেকে ক্রয়ের সুবিধাও রয়েছে। উদ্ভিদরাজির পাশাপাশি বাগানটিতে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন পশু-পাখির প্রতিকৃতি। বিশ্রামের জন্য নদের পাড়ঘেঁষে রয়েছে ৪০টির অধিক বিশ্রাম বেঞ্চ।

 

বোটানিক্যাল গার্ডেনটিতে কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন ড. মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, এই গার্ডেনটিকে একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে গার্ডেনটি।

 

এছাড়াও দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে জানতে ও দেখতে এখানে আসে। গার্ডেনটি সপ্তাহের রোব থেকে বৃহস্পতিবার পাঁচ দিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা এবং শুক্র ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্যে ফ্রি হলেও দর্শনার্থীদের জন্যে জনপ্রতি টিকিটমূল্য ১০ টাকা।

 

আরও খবর

Sponsered content