জাতীয়

মডেল ভিলেজের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান রোহিঙ্গারা ফিরতে চান নিজ গ্রামে

মডেল ভিলেজের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান রোহিঙ্গারা ফিরতে চান নিজ গ্রামে

মডেল ভিলেজে প্রত্যাবাসনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গারা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত কোনো চুক্তিতে মডেল ভিলেজে পাঠানোর কথা উল্লেখ নেই। ওই সব চুক্তিতে রাখাইন রাজ্যে নিজ গ্রামে কিংবা আশপাশের কোনো গ্রামে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার কথা রয়েছে। এখন মডেল ভিলেজে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গারা মনে করছে, নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারলে তারা ফেলে আসা সহায়-সম্পদ ফিরে পাবেন। গ্রীষ্মের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করাসহ পাঁচ দফা পেশ করেছেন রোহিঙ্গারা। কোভিড মহামারি এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সব উদ্যোগ দীর্ঘদিন স্থবির ছিল।

এ বিষয়ে মিয়ানমার ছিল একেবারেই নির্বিকার। অতি সম্প্রতি মিয়ানমার খানিকটা উদ্যোগী হয়েছে। অনেকে মনে করেন, চীনের তৎপরতার কারণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দৃশ্যত সক্রিয় হয়েছে।

মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল পাঁচবার বাংলাদেশে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিদলকে রাখাইন রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ দেখিয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল ফিরে এসে বলেছে, প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ মিয়ানমার সৃষ্টি করতে পারেনি।

কুতুপালং ক্যাম্পে বসে রোহিঙ্গা নেতা সাইদ উল্লাহ বলেছেন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি হয়েছে। একটি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের, আরেকটি বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের এবং তৃতীয় চুক্তি হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের। ২০১৮ সালে সই হওয়া কোনো চুক্তিতেই মডেল ভিলেজে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা নেই। এসব চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রত্যাবাসন হবে নিজ গ্রামে কিংবা কাছাকাছি গ্রামে।

তিনি আরও বলেন, মডেল ভিলেজ কিংবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ চুক্তির ঠিক বিপরীত। ওই নেতার প্রশ্ন, রোহিঙ্গারা কীভাবে এটা গ্রহণ করবে। মিয়ানমার যদি আমাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে তবে আমরা ফিরে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের যদি এখানকার ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের ক্যাম্পে যেতে হয় তবে এটা কীভাবে সম্ভব? এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্পে মানবাধিকার মেনে চলে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্যাম্পে হিউম্যান রাইটস বলতে কিছু নেই। আমরা ক্যাম্প থেকে অরিজিনাল মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই।

এক প্রশ্নের উত্তরে সাইদ উল্লাহ বলেন, বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে চান। সমস্যার সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। সমাধানও মিয়ানমারকে করতে হবে।

রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যাবাসন শুরু করার এখনই উপযুক্ত সময়। মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে বর্তমানে সংঘাত চলছে। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি সবচেয়ে শান্ত। রাখাইন রাজ্যের ইনসার্জেন্ট গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি চলছে। আরসার সঙ্গে কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি নেই। ফলে এখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সবচেয়ে ভালো সময়।

মিয়ানমারের আরেকটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশে আসবে। ডিসেম্বরের মধ্যে সাত হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে চায় বলে বাংলাদেশকে জানিয়েছে। মিয়ানমারের তরফে এটাও বলা হয়েছে যে, কাউকে কাউকে তাদের অরিজিনাল ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অবশিষ্টদের মডেল গ্রামে কিছুদিন রাখা হবে।

জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিপক্ষে। তারা বলছে, মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে।

রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যার পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস চেয়ারম্যান ডাক্তার মোহাম্মদ জোবায়ের।

তিনি বলেছেন, প্রত্যাবাসন সম্পর্কে যারা যাই বলছে সেগুলো রোহিঙ্গাদের মতামত নয়। রোহিঙ্গাদের মতামত তোয়াক্কা না করে সবাই মন্তব্য করছেন।

এই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, বাংলাদেশে আমরা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছি। এজন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সন্তান হচ্ছে। এখানে আর জায়গা হবে না। আমরা রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।

রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা: রোহিঙ্গা নেতারা পাঁচটি দাবি উত্থাপন করেন। এগুলো হলো-১. রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে তাদের আদি বসতবাড়িতে ফেরত পাঠাতে হবে। ২. আগামী গ্রীষ্মের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্যে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গাদেরও পূর্ণ নাগরিকত্ব ও তার সব অধিকার দিতে হবে। ৪. রোহিঙ্গারা অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে যাতে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন এবং দেশটির সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতায় অংশ নিতে পারেন সেই সুযোগ দিতে হবে।

৫. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও খবর

Sponsered content