সারাদেশ

সন্তানের আশায় মাতৃতুল্য চাচি হত্যা করল শিশুকে

নিজের সন্তান না থাকায় ভাশুরের ছেলে আইমান হক কায়েপকে (৫) মাতৃস্নেহে আগলে রাখতেন তিনি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই শিশুটিকে কাছে রাখতেন। শিশুটিও তাকে ‘ছোট আম্মু’ বলে ডাকত। কে জানত, কুসংস্কারে বিশ্বাস করে একদিন তিনিই হত্যা করবেন শিশুটিকে। বিয়ের চার বছরেও নিজের সন্তান না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত ছিলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পূর্ব গোমদণ্ডী গ্রামের গৃহবধূ আফরোজা আলম আনিকা। চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি কবিরাজ বাড়িতে গিয়েছিলেন ঝাড়ফুঁক নিতে। কোনো সফলতা না পাওয়ায় বিকৃত রুচি ও কুসংস্কার থেকে হঠাৎ তার মাথায় আসে– কোনো শিশুকে হত্যা করলে তিনি সন্তান জন্ম দিতে পারবেন।

 

এই ভাবনা থেকে মাথায় আঘাত করে আইমানকে হত্যার পর লাশ ঘরে লুকিয়ে রাখেন দু’দিন। এর পর শিশুটিকে ‘জিনে নিয়ে গেছে এবং তাকে মেরে ফেলেছে’ বলে গুজব ছড়াতে থাকেন আনিকা। স্বজনরা তার কথা বিশ্বাসও করেছিলেন।

 

হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পূর্ব গোমদণ্ডী গ্রামে। দু’দিন পর ঘরের পাশে শিশুটির লাশ পাওয়ার পর বোয়ালখালী থানায় অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছিল।

 

তবে ২০১৮ সালে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে মাথার তালুতে কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার তথ্য নিশ্চিত হলেও কে হত্যাকারী, তা বের করতে লেগে যায় কয়েক বছর।

 

অবশেষে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে জিন নয়, হত্যাকারী শিশুটির চাচি আনিকা।

 

তিনি একসময় বিপদ বুঝতে পেরে পালিয়ে যান। ফলে গ্রেপ্তার করা যায়নি। খুব শিগগির আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হবে বলে জানায় পিবিআই।

 

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এটি হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণ মেলায় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। বোয়ালখালী থানার বেশ কয়েকজন এসআই তদন্ত করেন। কিন্তু আসামি শনাক্ত হয়নি।

 

২০১৯ সালে মামলাটি তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কয়েক হাত ঘুরে ২০২২ সালের নভেম্বরে তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের এসআই কামাল আব্বাসের ওপর। তিনি সমকালকে জানান, আনিকা একাই আইমানকে হত্যা করেছে।

 

তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, আইমানের বাবা এজাহারুল হকরা চার ভাই। তারা একই ছাদের নিচে আলাদা কক্ষে বসবাস করেন। আইমানের ছোট চাচা জাহেদুল হক ফোরকান প্রবাসী হওয়ায় তাঁর স্ত্রী আফরোজা আলম আনিকা বাসায় একাই থাকতেন। সন্তান না হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

 

গাইনি চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়া থেকে শুরু করে কবিরাজের কাছে ঝাড়ফুঁক পর্যন্ত নিয়েছেন সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রত্যাশায়।

 

২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর সকালে আইমান আনিকার ঘরে মোবাইল ফোনে গেম খেলছিল। সাত দিন আগে আইমানের মা আরেক ছেলেসন্তান জন্ম দেন। এতে নিঃসন্তান আনিকা হিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন।

 

তার বিকৃত রুচিবোধের কারণে ভাবনা আসে– কোনো শিশুসন্তান হত্যা করলে তার গর্ভে সন্তান আসবে। এমনটি বিশ্বাস করে তাৎক্ষণিকভাবে আইনমানকে হত্যা করেন।

 

আইমানের মা ডাকাডাকির পর আনিকা দরজা খুলে বলেন, কিছুক্ষণ আগেই শিশুটি ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। আইমানকে মাথায় আঘাত করে হত্যার পর বাসার একটি কক্ষে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

 

আইমানের খোঁজে সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লে আনিকা নিজে নিজে বলতে থাকেন– ‘রাতে যে স্বপ্ন দেখলাম, এটাই কি হলো? না জানি আইমানকে জিনে নিয়ে গেছে।’ শিশুটিকে জিনে নিয়ে গেছে এবং মেরে পুকুরের পানিতে ফেলে গেছে– এমন জোর গুজব ছড়ান আনিকা।

 

আনিকা আইমানকে মাতৃস্নেহে আদর করতেন। তাই তার কথা বিশ্বাস করেন পরিবারের সবাই। আনিকা শিশুটিকে হত্যা করতে পারেন– এমনটি ধারণাতেই আসেনি কারও।

 

নিখোঁজের দু’দিন পর দুপুরে বাবা এজাহারুল হককে আনিকা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, জীবিত কিংবা মৃত হোক আইমানকে জিন অবশ্যই ফেরত দেবে।

 

তার ঘরের পূর্ব পাশে আলোর ঝলক দেখতে পেয়েছেন তিনি। সেখানে আইমানকে জিনে রেখে গেছে কিনা বলে এজাহারুলকে ডেকে নিয়ে যান আনিকা। সেখানে লাকড়ির স্তূপের মধ্যে শিশুটির লাশ পাওয়া যায়।

 

আরও খবর

Sponsered content